হাই প্রেশার, লো প্রেশার কি- ভালভাবে বুঝিনা, কিভাবে শিখব সহজে?

ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ (রক্তচাপ) কি বুঝে নিই

একজন লোক লম্বা প্লাস্টিকের ফ্লেক্সিবল পাইপ হাতে বাগানে পানি দিচ্ছে, আর মাঝখানে পাইপ ফেটে পানি ছিটকে পড়ছে এখানে সেখানে- আপনারা এমন দৃশ্য কি দেখেননি? নিশ্চয় দেখেছেন। পাইপ ফেটে পানি বের হয়ে যাওয়ার কারন কি? কারন হল- পাইপের ভিতরে পানির চাপ বেশি। হয়তবা পানির অতিরিক্ত চাপের কারনে আগেই পাইপ ফেটে আছে। পানির চাপ কম হলে হয়ত পাইপটি ফাটতনা। আমাদের দেহের ভিতরেও এই পাইপের মত অসংখ্য রক্তনালী আছে। এই রক্তনালী দিয়ে আবিরাম রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এই রক্তেরও একটি চাপ আছে। সহজ কথায়, এটাই রক্তচাপ বা Blood Pressure।

হাই প্রেসার ও লো প্রেসার

আরো সহজ করে বললে-

আমাদের সারা দেহে ছড়িয়ে আছে ছোট বড় অসংখ্য রক্তনালি। কোনটি চিকন তারের মত, আস্তে আস্তে সরু হতে হতে কোনটি আবার চুলের মত সূক্ষ্ম। এরা মিলে সারা দেহে রক্ত চলাচলের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে রেখেছে।

এই নেটওয়ার্কের মূল কেন্দ্র হল আমাদের হার্ট বা হৃদ্‌পিন্ড (Heart)। হৃদ্‌পিন্ড হল রক্ত পাম্প করার মেশিন। হৃদ্‌পিন্ড জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রক্ত পাম্প করার মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত প্রবাহমান রেখে জীবনীশক্তিকে চালু রেখেছে। হৃদপিন্ড থেমে যাওয়া মানে মৃত্যু।

হৃদপিন্ড কিভাবে রক্ত পাম্প করে?

হৃদপিন্ড হল একটি ফ্লেক্সিবল মেশিন যা বেলুনের মত ফুলে যেতে পারে, আবার চুপসে যেতে পারে। হৃদপিন্ড এভাবে ফুলে ও চুপসে যাওয়ার মাধ্যমে বা সংকোচন-প্রসারনের মাধ্যেমে রক্ত পাম্প করে। হৃদপিন্ড সংকুচিত হলে বা চুপসে গেলে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে; আবার প্রসারিত হলে বা ফুলে উঠলে সারা দেহ থেকে রক্ত হৃদপিন্ডে ফিরে আসে। মেডিকেলের ভাষায় এটাই রক্ত সংবহন তন্ত্র বা Blood Circulatory System। হৃদপিন্ড সংকুচিত হলে যে নালি দিয়ে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, তাকে বলে ধমনি (Artery)। আর প্রসারিত হলে যে নালি দিয়ে রক্ত সারা দেহ থেকে হৃদপিন্ডে ফিরে আসে, তাকে বলে শিরা (Vein)।

হৃদপিন্ড যেন কামারের হাপর!

হৃদ্‌পিন্ডের এ কার্যপদ্ধতিকে তুলনা করা যায় কামার শালার হাপরের সাথে। দেখেছেন কেউ হাপর। কামারের দোকানে একজন লোক হাপরের দড়িটাতে টান দিলে, হাপর প্রসারিত হয়ে বাতাস ঢুকে, আবার ছেড়ে দিলে হাপর সংকুচিত হয়ে বাতাস বের হয়ে গিয়ে আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করে।

রক্তচাপ (Blood Pressure) টা তাহলে কি?

হৃদপিন্ডের সংকোচন-প্রসারনের সময় রক্ত ধমনির গায়ে ভিতরের দিকে যে চাপ দেয়, তাই রক্তচাপ (Blood Pressure)। এই রক্তচাপ দুইটি মাত্রায় মাপা হয়। হৃদপিন্ড সংকুচিত হলে রক্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ার সময় ধমনির দেয়ালে যে চাপ দেয়, সেটা হল সিস্টোলিক প্রেসার (Systolic Pressure)। আবার হৃদপিন্ড প্রসারিত হলে সারা দেহ থেকে রক্ত ফিরে আসার সময় ধমনির ভিতরের দেয়ালে যে চাপ দেয়, সেটা হল ডায়াস্টোলিক প্রেসার (Diastolic Pressure)। দুটো ক্ষেত্রেই ধমনির উপর রক্তের চাপ মাপা হয়, শিরার উপরে নয়।

রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার কিভাবে মাপা হয়?

রক্তচাপ মাপা হয় মিলিমিটার মার্কারি বা mmHg এককে। স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের রক্তের চাপ থাকে সিস্টোলিক ১২০ ও ডায়াস্টোলিক ৮০; অর্থাৎ ১২০/৮০। অর্থাৎ বাইরের দিকে চাপ দিলে ১২০ এবং ভিতরের দিকে টান দিলে ৮০। সাধারন মানুষের ভাষায়- উপরেরটা ১২০ আর নিচারটা ৮০। এই হল স্বাভাবিক রক্তচাপ। অর্থাৎ রক্তচাপ মানুষের থাকবেই। একথা বলার কোন অর্থ নাই- লোকটা ব্লাড প্রেসারে ভুগছে। রক্তচাপ তো সবারই থাকবে। প্রশ্ন হল- সেটা কম না বেশি বা হাই না লো। রক্তচাপ ১২০/৮০ বা তার কিছুটা কম-বেশি হলে সেটা স্বাভাবিক রক্তচাপ যা ক্ষতিকর নয়।

হাই প্রেসার (High Pressure) আর লো প্রেশার (Low Pressure)

হাই প্রেসার (High Pressure) কে ইংরেজিতে বলে ‘হাইপারটেনশন (Hypertension)’ আর লো প্রেশার (Low Pressure)কে বলে ‘হাইপোটেনশন’ (Hypotension)। আপনার স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০। এই থাকে কিছুটা নীচে বা কিছুটা উপরে উঠে গেলেও সমস্যা নেই। বেশিরভাগ ডাক্তারদের মতে, সিস্টোলিক ১৪০ ও ডায়াস্টোলিক ৯০ অর্থাৎ- রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর উপরে উঠে গেলে সেটা উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure)। আর সিস্টোলিক ৯০ ও ডায়াস্টোলিক ৬০ অর্থাৎ- রক্তচাপ ৯০/৬০ এর নীচে নেমে গেলে সেটা নিম্ন রক্তচাপ (Low Blood Pressure)।

কিন্ত সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তিভেদে স্বাভাবিক রক্তচাপের মাত্রা কম বেশি হতে পারে। এমন হতে পারে যে কারো রক্তচাপ বছরের পর বছর ধরে ১০০/৭০ থাকছে, এতে তার কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তাহলে এটাই তার জন্য স্বাভাবিক। আবার স্বাভাবিক রক্তচাপের সাথে বয়সের বিষয়টিও জড়িত।

উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) বা হাইপারটেনশন

উচ্চ রক্তচাপের সাথে তো নিশ্চয় আপনাদের কিছুটা পরিচয় আছে। নিজের না হলেও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এমন কারো সাথে নিশ্চয় পরিচয় আছে। আর উচ্চ রক্তচাপের ভুগান্তির কথাও নিশ্চয় জানেন। উচ্চ রক্তচাপ এমন একটি রোগ যা যে কোন মুহুর্তে কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেলে ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট স্ট্রোকের মত ঘটনা ঘটে মুহুর্তের মধ্যে জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। হাই প্রেসারে ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট স্ট্রোক ছাড়াও শরীরের অন্যান্য স্থানে স্ট্রোক হয়ে ছিড়ে যেতে পারে রক্তনালি, প্যারালাইস্‌ড হয়ে যেতে পারে শরিরের অংশবিশেষ।

চলুন জেনে নিই, কি কি কারনে হয় এই মরনঘাতি উচ্চ রক্তচাপ-

কেন হয় উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার?

উচ্চ রক্তচাপের কারনগুলো এক নজরে দেখে শিখে নিন-

রক্তনালি সংকুচিত হয়ে যাওয়া

রক্তনালি সংকুচিত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল রক্তে চর্বি জমা। এটা হতে পারে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের কারনে। কোলেস্টেরল জমতে জমতে রক্তনালিতে ব্লক তৈরি হয়। এছাড়া ট্রাইগ্লিসারাইড রক্তনালির গায়ে জমে রক্ত চলাচলের জায়গাকে সংকুচিত করে দেয়। এতে রক্ত স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেনা। এর ফলে দেহের সকল স্থানে রক্ত পৌঁছানোর জন্য হার্টকে জোর প্রয়োগ করে পাম্প করতে হয়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তচাপের ফলে সংকুচিত স্থানে স্ট্রোক হতে পারে বা রক্তনালী ছিড়ে যেতে পারে।

রক্তের পরিমান (Volume) বেড়ে যাওয়া

বিভিন্ন খাদ্যের কারনে বা রোগের কারনে শরীরে রক্তের মোট পরিমাণ বা আয়তন (ভলিওম) বেড়ে যেতে পারে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে রক্তের মোটামুটি পরিমাণ থাকে ৫ থেকে ৬ লিটার। কিন্তু এই আয়তন হঠাৎ বেড়ে গেলে রক্তনালির উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। হার্টকে রক্ত পাম্প করার জন্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করতে হয়, যার নাম উচ্চ রক্তচাপ।

লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া

অতিরক্ত লবন বা লবন জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে কখনো কখনো শরীরে খাবার লবন বা সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। লবন রক্তে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখে। ফলে রক্তনালিতে মোট রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে।

টেনশন বা মানসিক চাপ (Tension or Stress)

উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ বা স্ট্রেস বৃদ্ধির সবচেয়ে আধুনিক কারন। কারন সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মানুষ শুধু দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। তার পায়ের নীচে মনে হয় চাকা লাগানো। তার সামান্যতম অবসর নেই একটু বিশ্রামের, এমনকি ভালভাবে খাওয়ার এবং নিজের যত্ন নেওয়ার। এভাবে সৃষ্টি হচ্ছে শারীরিক-মানসিক চাপ।

দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, হৃদপিন্ডে চাপ সৃষ্টি করে, ধমনিকে শক্ত করে, রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ সীমিত করে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।

উপরোক্ত কারনগুলো হল উচ্চ রক্তচাপের একেবারে প্রত্যক্ষ কারন অর্থাৎ সরাসরি যে কারনে হয়। কিন্তু এই কারনগুলির পেছনের কারন কি? এগুলোর পেছনে রয়েছে আমাদের কিছু কিছু কাজ, আচরণ, অভ্যাস ও খাদ্যাভ্যাস বা লাইফস্টাইলজনিত কারন, যার কারনে রক্তনালিতে ব্লক হচ্ছে, রক্তনালি সংকুচিত হচ্ছে, স্ট্রেস হচ্ছে ইত্যাদি। চলুন সেই সেই পেছনের বা ব্যাকগ্রাউন্ডের কারনগুলো জেনে নিই-

উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার এর পরোক্ষ কারন?

  • নিয়মিত ব্যায়াম না করা।
  • ক্যালরিযুক্ত খাবার- শর্করা, প্রোটিন, চর্বি; বিশেষ করে চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া।
  • খাবারে লবনের পরিমাণ বেশি থাকা।
  • দীর্ঘ বছর যাবত ভাল ঘুমের ঘাটতি থাকা এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাওয়া।
  • ধুমপানের অভ্যাস থাকা
  • অ্যালকোহল পানের অভ্যাস থাকা।
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা থাকা।
  • অত্যধিক কাজের চাপ বা সব সময় শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকা এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাওয়া।

প্রিয় পাঠক, আপনার জীবনে যদি লাইফস্টাইলজনিত এ অভ্যাসের ঘাটতিগুলো থেকে থাকে, তবে এখনি পরিবর্তন করে ফেলুন আর উচ্চ রক্তচাপের ভয়ংকর ক্ষতি থেকে বাঁচুন।

 

নিম্ন রক্তচাপ (Low Blood Pressure) বা হাইপোটেনশন

আমরা আগেই বলেছি, মানুষের রক্তের স্বাভাবিক চাপ ১২০/৮০। রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ এর নীচে নেমে যায়, সাধারনভাবে সেটাকেই বলে নিম্ন রক্তচাপ বা লো প্রেসার। লো প্রেসার মানেই হল রক্তনালিতে (ধমনিতে) প্রবাহিত রক্তের চাপ কমে যাওয়া।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্ন রক্তচাপ বা লো প্রেশার, উচ্চ রক্তচাপের মত কোন রোগ নয়। এবং এর সাধারণত এর প্রতিক্রিয়াও উচ্চ রক্তচাপের মত ভয়ংকর নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে লো প্রেশার চলতে থাকলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। লো প্রেশার এর কারনগুলো এক নজরে দেখে নিই-

লো প্রেসারের কারন

  1. হরমোনজনিত কারনে, বিশেষ করে থাইরয়েড ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির হরমোন সমস্যার কারনে।
  2. ডায়রিয়া, বমি, রক্তক্ষরণ, রক্তশূন্যতা বা পানিশূন্যতা থেকে।
  3. অতিরিক্ত ক্লান্তির কাজ এবং অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারনে।
  4. ঠিকমত খাওয়া দাওয়া না করলে বা দীর্ঘ সময় খাবার গ্রহনে গ্যাপ থাকলে।
  5. প্রচুর পটাশিয়ামযুক্ত খাবার বা ফল খাদ্য তালিকায় থাকলে।
  6. অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারনে।
  7. কিছু ড্রাগের কারনে।
  8. কম ঘুম।

লো প্রেসার হলে কি কি সমস্যা হয়

  1. মাথা ঝিমঝিম, মাথা ঘোরা বা মাথা হালকা বোধ করা।
  2. হঠাৎ বসে পড়লে বা দাঁড়িয়ে গেলে ভারসাম্যহীনতা।
  3. চোখে অন্ধকার দেখা।
  4. দুর্বল বোধ হওয়া।
  5. হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
  6. খুব তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া।
  7. হঠাৎ পড়ে যাওয়া বা জ্ঞান হারানো।
লো প্রেশার হলে করণীয়

লো প্রেশারকে হাই করতে যে যে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা একনজরে দেখে নিই-

  1. লবন দিয়ে ডিম, বাদাম খাওয়া।
  2. রেডমীট- খাসি, গরুর মাংস খাওয়া।
  3. সামুদ্রিক মাছ খাওয়া।
  4. প্রেসার বেশি লো হলে কুসুম গরম পানিতে লবন মিশিয়ে খাওয়া।
  5. ভিটামিন B12 খাওয়া।
  6. রেস্ট এ থাকা।

মন্তব্য করুন