চর্বি (Fat), কোলেস্টেরল (Cholesterol) ও ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglyceride) প্রায় একই জাতীয় তিনটি উপাদান, যা আমাদের শরীরে- রক্তে, মাংসে বা পেশিতে, কোষে, লিভারে, ব্রেইনে জমা হয়ে থাকে বা মিশে থাকে।
কিন্ত এদের গঠন, জমা হওয়ার পদ্ধতি ও কার্যপ্রনালীর মধ্যে আছে সুস্পষ্ট পার্থক্য, যা শিখে রাখা প্রতিটি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এরা শরীরের বিভিন্ন স্থানে জমা হয়ে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ করে অর্থাৎ উপকার করে। কিন্তু এদের অতিরিক্ত উপস্থিতি কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের বা হৃদ্যন্ত্র (Heart) ও রক্তনালীর ভয়ংকর ক্ষতি করে।
চর্বি (Fat), কোলেস্টেরল (Cholesterol) ও ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglyceride) কে একত্রে বলা হয় লিপিড (Lipid)। ডাক্তাররা প্রায়শই “লিপিড প্রোফাইল (Lipid Profile)” নামক রক্তের টেস্ট দেন। এর মাধ্যেমে হার্টের অবস্থা, রক্তনালী, রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টি হচ্ছে কিনা- এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেন। লিপিড প্রোফাইল টেস্টে থাকে- টোটাল কোলেস্টেরল এর মাত্রা, HDL Cholesterol, LDL Cholesterol, ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা এবং এদের বিভিন্ন রেশিও। এই পোস্টে আমরা সবকিছুই সুস্পষ্টভাবে শিখব।
আপনার প্রয়োজনে আমাদের নিচের পোস্টটিও পড়ে নিতে পারেন, বেশ সহায়ক হবে।
পড়ুন: কোলেস্টেরল কি? কোলেস্টেরল মানেই কি খারাপ? কোলেস্টেরল কেন কমাব?
চর্বি থেকে শুরু
চর্বি বা ফ্যাট (Fat) আমরা সবাই চিনি। চর্বি হল বেসিক্যালি তেল জাতীয় জিনিস। গরুর মাংসে বা অন্যান্য মাংসে আমরা স্পষ্টত চর্বি দেখে থাকি। মাংস, খাবার তেল, ডিমের কুসুম, ঘি, মাখন- এগুলি হল চর্বির প্রধান উৎস। খাদ্যের উপাদান ছয়টি- শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, লবন ও পানি। এর মধ্যে একটি হল এই চর্বি।
আমরা চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে চর্বি শরীরে গ্রহন করি। এই চর্বি শরীরের বিভিন্ন জায়গায়- কোষে, পেশিতে, পেটে, উরুতে, লিভারে, হার্টে, ব্রেইনে জমা হয়। শুধু চর্বি জাতীয় খাবারই নয়, আমিষ (প্রোটিন) এবং শর্করা খাবারও যা আমরা খাই, সেটা দেহে সাময়িকভাবে কাজে লাগার পর অতিরিক্তটা চর্বি আকারে দেহের কোষে জমা হয়।
তাহলে এ থেকে কি শিখলাম? চর্বি যা একটি তৈলাক্ত খাবার- সেটা আমরা দেহের বাইরে থেকে খাবারের মাধ্যমে গ্রহন করি। এটা দেহের ভিতরে আপনাআপনি তৈরি হয়না। পক্ষান্তরে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড আমরা খাবারের মাধ্যমে গ্রহন করিনা। কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি হয় চর্বি থেকে দেহের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ডের ফলে।
এবার চলুন চর্বির উপকারিতা অপকারিতা সম্পর্কে আরো কিছু জেনে নিই-
চর্বির উপকারিতা
- চর্বির প্রধান কাজ দেহের তাপশক্তি উৎপাদন করা।
- প্রয়োজনের সময় দেহ সঞ্চিত চর্বি খরচ করে দেহকে কর্মক্ষম রাখে।
- বিভিন্ন হরমোনের উৎপাদন করে।
- আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় ৬০% ই চর্বি দিয়ে গঠিত। চর্বি মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধন করে এবং মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম রাখে।
- চুল ও ত্বকের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
চর্বির অপকারিতা
- দেহের কোষ চর্বি দ্বারা ওভারলোড হলে তাকে বলে ডায়াবেটিস।
- লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে তাকে বলে ফ্যাটি লিভার; ফ্যাটি লিভার থেকে হয় লিভার সিরোসিস।
- অতিরিক্ত চর্বির কারনে হার্ট ব্লক, হার্ট স্ট্রোক, রক্তনালীতে ব্লক, ব্রেইন স্ট্রোক ইত্যাদির মত শারীরিক সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়।
মনে রাখবেন, অতিরিক্ত চর্বি যেমন ভয়াবহ মরনঘাতি রোগের সৃষ্টি করে; প্রয়োজনীয় চর্বির অভাবেও তেমনি ব্রেইনের কার্যক্ষমতা হ্রাস ও স্নায়ুবৈকল্য থেকে নানাবিধ জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
চর্বি থেকে কোলেস্টেরল
কোলেস্টেরল হল এক ধরনের চর্বি। ভাল করে খেয়াল করুন- চর্বি এক ধরনের কোলেস্টেরল নয়, কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বি। অর্থাৎ চর্বি থেকেই কোলেস্টেরল হয়। আগেই বলেছি, আমাদের দেহে চর্বি আসে, শুধু চর্বি জাতীয় খাবার থেকে নয়, শর্করা এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকেও। এই চর্বি থেকেই দেহ নিজে নিজেই কোলেস্টেরল তৈরি করে। এছাড়া খাবার থেকে আমরা সরাসরিও কোলেস্টেরল পাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমরা কোলেস্টেরল খাইনা, চর্বি খাই।
প্রশ্নঃ দেহের ভিতরে কোলেস্টেরল কোথায় তৈরি হয় বা কে তৈরি করে?
উত্তরঃ কোলেস্টেরল প্রধানত তৈরি হয় লিভারে। লিভার দেহের জমাকৃত চর্বি ব্যবহার করে কোলেস্টেরল তৈরি করে। এছাড়াও, অন্ত্র, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি, এবং অন্যান্য টিস্যুতেও এটি তৈরি হয়। ইনসুলিন কোলেস্টেরলের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে।
প্রশ্নঃ কোলেস্টেরল কোথায় থাকে বা জমা হয়?
উত্তরঃ কোলেস্টেরল থাকে Cell Membrane বা কোষের পর্দায়। এছাড়া মোম সদৃশ এ পদার্থটি অতিরিক্ত হলে রক্তনালীতে এসে জমা হয়। খারাপ কোলেস্টেরলগুলো (Bad Cholesterols) ধীরে ধীরে রক্তনালীতে (ধমনীতে) প্লেক (Plaque) সৃষ্টি করে এবং রক্তনালীর সরবরাহ পথকে সংকুচিত করতে দেয়। এক পর্যায়ে রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টি হয়। ফলে দেহ ভয়াবহ স্ট্রোকের ঝুঁকি ও হৃদ্রোগের কবলে পড়ে। আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ যত বেশি, হৃদরোগের ঝুঁকি তত বেশি।
প্রশ্নঃ কোলেস্টেরল কি শুধু ক্ষতিকারকই? এর কি উপকারি ভূমিকা নেই
উত্তরঃ অবশ্যই আছে। কোলেস্টেরল এর নাম উচ্চারিত হলে আমরা শুধু কোলেস্টেরল কমানোর কথাই ভাবি। কিন্তু কোলেস্টেরল এর আছে অনেক উপকারিতা। শরীরে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ নীচে নেমে গেলে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন ব্যাহত হয়ে এরেক্টাইল ডিসফাংশন (Erectile Dysfunction) এর মত যৌন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। দেখে নিন কোলেস্টেরল এর উপকারিতাগুলো-
- কোলেস্টেরল দেহকোষের গঠনের জন্য প্রয়োন।
- কোলেস্টেরল হরমোন ও ভিটামিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
- কোলেস্টেরল কোষের কার্যকারিতার জন্য শক্তি সরবরাহ করে।
- কোলেস্টেরল ভিটামিন ডি সহযোগে ‘টেস্টোস্টেরন’ নামক যৌন হরমোন তৈরি করে।
কোলেস্টেরল আবার দুই প্রকার- ভাল কোলেস্টেরল (HDL) ও খারাপ কোলেস্টেরল (LDL)। শরীরে কোলেস্টেরল এর মাত্রা ঠিক রাখার জন্য আমাদের ভাল কোলেস্টেরল বেশি করে খেয়ে খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমিয়ে রাখতে হবে। কারন, রক্তনালীর ব্লকেজের জন্য খারাপ কোলেস্টেরলই দায়ি।
ভাল কোলেস্টেরল (HDL) ও খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) সম্পর্কে নিচের লিঙ্ক থেকে পড়ে নিন-
পড়ুন: ভাল কোলেস্টেরল (HDL) ও খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) মানে কি?
চর্বি থেকে ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglyceride)
কোলেস্টেরল এর সাথে ট্রাইগ্লিসারাইড এর অনেকটা মিল আছে, আছে ব্যাপক অমিলও। ট্রাইগ্লিসারাইডও এক ধরনের চর্বি বা চর্বিরই একটি রূপ। কোলেস্টেরল যেমন মোমের মত পদার্থ এবং প্লেক সৃষ্টি করে রক্তনালীতে বাঁধ দিয়ে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে, ট্রাইগ্লিসারাইড তেমন নয়। ট্রাইগ্লিসারাইড হল রক্তে ভেসে বেড়ানো ফ্যাট কোষ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে থাকা চর্বি এবং শর্করা ট্রাইগ্লিসারাইডে রূপান্তরিত হয় এবং রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রবাহিত হয়। ট্রাইগ্লিসারাইড প্লেক বা বাঁধ সৃষ্টি করেনা। রক্তে এর মাত্রা বেড়ে গেলে রক্তনালির গায়ে জমতে থাকে এবং রক্ত প্রবাদে বাধার সৃষ্টি করে। তখনই হার্টের সমস্যা শুরু হয়।
ট্রাইগ্লিসারাইড এর উপকারী ভূমিকা
ট্রাইগ্লিসারাইড রক্তে ফ্যাট কোষ হিসাবে ভেসে বেড়ায়। এই ফ্যাট কোষে শক্তি সঞ্চিত থাকে। ট্রাইগ্লিসারাইড এর প্রধান কাজ প্রয়োজনের সময় শক্তির জোগান দিয়ে দেহকে সচল রাখা।
ট্রাইগ্লিসারাইড এর ক্ষতিকর ভূমিকা
ট্রাইগ্লিসারাইডগুলি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক কারন তারা ধমনীগুলিকে শক্ত বা ঘন করে ফেলতে পারে। এভাবে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সহজে মনে রাখি- চর্বি, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড
মূল পয়েন্টগুলোকে আমরা এভাবে মনে রাখতে পারি। চর্বি হল যা আমরা খাদ্যের মাধ্যমে সরাসরি গ্রহন করি। কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড দুটোই এক ধরনের চর্বি। কিন্তু এগুলোকে আমরা চর্বির মত সরাসরি খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করিনা। সাধারন চর্বি দেহের সব জায়গায় জমা হয় এবং কোষে জমা হওয়া চর্বি প্রধানত ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। পক্ষান্তরে,কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড দুটোই রক্তনালীতে জমে; বিশেষত ধমনীতে। কোলেস্টেরল রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টির জন্য দায়ী কিন্তু ট্রাইগ্লিসারাইড ব্লক সৃষ্টি না করেও রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে। কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড দুটোই হার্ট স্ট্রোক এবং হার্ট ও ধমনীর অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
মনে রাখবেন, নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকলে চর্বি, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড তিনটিই শরীরের জন্য উপকারী এবং এদের ঘাটতি হলে বিভিন্ন রোগ ও শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হবে।