প্রশান্তির জন্য শিখিঃ দেহের ‘ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স’ কি? কিভাবে ব্যালেন্স করব?

আমরা অনেকেই জানি, আমরা যে খাবার খাই তাতে ছয় ধরনের খাদ্য উপাদান আছে। এগুলো হল- শর্করা, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবন ও পানি। আমাদের আজকের কথাবার্তা খনিজ লবণ বিষয়ে। অর্থাৎ ‘ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স’ বা ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা মানে খনিজ লবণের ভারসাম্যহীনতা। প্রয়োজনে খাদ্য সম্পর্কিত আমাদের নিচের লেখাটি পড়ে নিন।

পড়ুন: বিভিন্ন খাদ্য, খাদ্যের কাজ, অভাবজনিত রোগ – কিভাবে শিখতে পারি সহজে?

কিন্তু লবণ বলতে আমরা যে সাদা লবন খাই আমরা শুধু সেটাকেই বুঝে থাকি। সাদা লবনটা হল সোডিয়াম ক্লোরাইড (Sodium Chloride বা NaCl). কিন্তু লবণ মানে কিন্তু শুধু সোডিয়াম ক্লোরাইড নয়, আরো অনেক ধরেনের লবণ আছে, যা দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এগুলো লবণ হিসাবে আমাদের হাতে না আসলেও, বিভিন্ন খাবার এবং সব্জির মাধ্যমে তা খেতেও পারছি। এগুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে জানব।

জেনে নিই ইলেক্ট্রোলাইট কি?

সোডিয়াম ক্লোরাইড অর্থাৎ সোডিয়াম লবণ ছাড়াও আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন বেশ কিছু খনিজ ও লবণ; যেমন- ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ইত্যাদি। আমরা হয়ত সারাজীবনেও সোডিয়াম লবণ ছাড়া অন্যান্য লবণের ব্যাপারে সচেতন হইনি। কিন্তু হয়ত কোন না কোনভাবে খাবারের মাধ্যমে তা গ্রহন করছি, ফলে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। কিন্তু কোন একটি লবনের ঘাটতি যখন তীব্রভাবে দেখা দেয়, আর লবন ঘাটতিজনিত শারীরিক সমস্যায় পড়েন তখন বুঝা যায় তার প্রয়োজন কত তীব্র ছিল। আর দেহের জন্য আবশ্যকীয় সব খনিজ ও লবণই হল ইলেকট্রোলাইট (Electrolyte)।

এবার চলুন কয়েকটি ইলেকট্রোলাইট সম্পর্কে জেনে নিই।

সোডিয়াম (Sodium)

সোডিয়াম ক্লোরাইড হল সাধারন খাবার লবন যা টেবিল লবণ হিসাবে পরিচিত। এই সাদা লবণের প্রাকৃতিক উৎস হল সমুদ্রের জল। আমরা স্বাদ বর্ধক হিসাবে তরকারিতে ব্যবহার করে এই লবণ খাই এবং একই সাথে আলাদাও খাই। আমাদের শরীরের জন্য দৈনিক প্রায় ৫ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড প্রয়োজন। সোডিয়াম লবণ রক্তচাপ ও রক্তের পরিমাণ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। শরীরে তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনেও এটি সাহায্য করে।

সোডিয়াম লবণ কমে গেলে নিম্ন রক্তচাপ, বমি বমি ভাব, পেশির খিঁচুনি, অস্থিরতা, দুর্বলতা, ক্লান্তি ইত্যাদি দেখা দেয়। খাবার লবন বেশি খেলে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

পটাশিয়াম

পটাশিয়াম লবণ বা পটাশিয়াম ক্লোরাইড (KCl) লবণও সাদা বর্ণের যা সমুদ্র থেকে বা স্থলে পাওয়া যায়। তবে সচরাচর এই লবন সাদা লবণ হিসাবে আমাদের হাতে আসেনা। পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে পারে কলা। এছাড়া পটাশিয়ামের একটি ভাল উৎস হল ডাবের পানি। ডাক্তাররাও পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণে ডাব খেতে বলেন। শাকসব্জি, মিষ্টি আলু, মটরশুটি, মসুর ডাল, আলু ইত্যাদিতেও কিছু পরিমাণে পটাশিয়াম আছে।

শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা কমে গেলে দীর্ঘস্থায়ী বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে পটাশিয়ামের মাত্রা কম থাকলে শরীরে ইনসুলিন কম উৎপাদিত হয় এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে। রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা ২.৫ মিলিমোলের নিচে চলে গেলে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে প্রাণহানীও ঘটতে পারে।

ক্যালসিয়াম

ক্যালসিয়াম লবনও আমরা সচরাচর লবণ হিসাবে খাইনা। যে খাবারে বেশি বেশি ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় সেগুলো হল- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, যেমন-দই, পনির। এছাড়া ডিম, বাদাম, কুমড়ার বীজ, আখরোট, সামুদ্রিক মাছ, ডাল,শুটকি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।

আমাদের হাড় ও দাঁতের প্রধান উপাদান হল ক্যালসিয়াম। সুতরাং শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে হাড় ও দাঁতের ক্ষয় শুরু হয়। হাড় ক্ষয়ের ফলে হাড় ভেঙ্গে যাওয়া সহ আরো নানাবিধ জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া চুল ও ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, স্মরনশক্তির সমস্যা, স্নায়ুবিক জটিলতা, খিঁচুনি ইত্যাদিও ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর অন্যতম।

ম্যাগনেসিয়াম

আমাদের শরীরের প্রায় ৬০% ম্যাগনেসিয়াম থাকে হাড়ের মধ্যে। সুতরাং ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে হাড়ের স্বাস্থ্য দুর্বল হয়। হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এছাড়া ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতিতে উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, অনিদ্রা, হাত-পায়ে ঝিম ধরা, মাংসপেশীতে ব্যাথা, ক্লান্তি ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার ম্যাগনেসিয়ামের ভাল উৎস। চীনাবাদাম, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, মিষ্টিকুমড়ার বিচি, সূর্যমুখীর বিচি ইত্যাদিতে উচ্চমাত্রার ম্যাগনেসিয়াম থাকে। এ ছাড়াও পালংশাক, কলমি শাক, সবুজ শাক, ডাল, সয়াবিন, ছোলা থেকে ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়।

আয়রন

লৌহ বা আয়রন আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। আয়রন রক্তের লৌহ কণিকা তৈরির প্রধান কাঁচামাল। আয়রনের অভাবে লোহিত কনিকা (RBC) তৈরি হতে পারেনা। ফলে রক্তশূণ্যতা বা রক্তাল্পতা দেখা দেয়। এছাড়া দেহের শক্তি উৎপাদন এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুপ্রবাহও আয়রনের উপর নির্ভরশীল। আয়রনের ঘাটতিতে শারীরিক দুর্বলতা, মাথা ঘোরানো, স্মরণশক্তির ঘাটতি, চুল পড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।

মুরগির মাংস এবং সামুদ্রিক খাবারে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে। কলিজা আয়রনের একটি ভাল উৎস। এছাড়া ছোলা, কচুশাক, পালংশাক, ডাল ইত্যাদিতেও আয়রন পাওয়া যায়।

আয়োডিন

আয়োডিন লবণের সবচেয়ে ভাল উৎস হল আয়োডিনযুক্ত লবণ। আমাদের দেশে সাধারন খাবার লবণের সাথে আয়োডিন মেশানো থাকে, যা পূর্বে ছিলনা। ফলে সহজেই আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ হয়। এছাড়া আঙ্গুর, আপেল, ডালিম, তরমুজ, দুধ, দই ও রসুনে আয়োডিন আছে।

আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড রোগ হয়। গলগন্ড হল থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া রোগ। এই রোগে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গলার সামনে ঝুলে থাকে। এছাড়া শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তির জন্য আয়োডিন একটি অপরিহার্য উপাদান।

 

ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স মানে কি?

এতক্ষনে আমরা নিশ্চয় বুঝে নিয়েছি যে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স ব্যাপারটি কি হতে পারে। অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স মানে হল আমাদের দেহে ইলেকট্রোলাইটের ভাবসাম্যহীনতা বা আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপরোক্ত খনিজগুলোর ভাবসাম্যহীনতা। অর্থাৎ সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন ইত্যাদি খনিজগুলির পরিমাণ যদি আমাদের দেহে বেড়ে যায় বা কমে যায় তাহলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় যা নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে; এটাই ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স।

ইলেকট্রোলাইটের মাত্রা কমে বা বেড়ে গেলে যে যে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, তা আমরা উপরে আলোচনা করেছি। ভিন্ন ভিন্ন খনিজের আধিক্য বা ঘাটতিতে সেটা ভিন্ন ভিন্ন হবে। যাই হোক, ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স এর সাধারন কিছু উপসর্গ নিম্নরূপ-

  • শারীরিক দুর্বলতা
  • মাথা ঘোরা
  • মাংসপেশি কামড়ানো
  • পেশিতে টান পড়া
  • পেশির অসাড়তা
  • খিঁচুনি
  • অনিয়মিত হৃদ্স্পন্দন
  • রক্তচাপের পরিবর্তন
  • স্নায়ুতন্ত্রের ও হাড়ের সমস্যা

সুতরাং আমাদেরকে সর্বদা আমাদের শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স করে রাখতে হয়।

যে যে কারনে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হতে পারে

  1. একই ইলেকট্রোলাইট যুক্ত খাবার বেশি খেলে
  2. নির্দিষ্ট একটি ইলেকট্রোলাইট কম গ্রহন করলে
  3. ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা বা বমি হলে
  4. পরিশ্রম বা ব্যায়ামের কারনে অত্যধিক ঘামের ফলে শরীর থেকে প্রচুর তরল বেরিয়ে গেলে
  5. পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার জন্য। যার কারণে গৃহীত খাদ্য থেকে ইলেকট্রোলাইট শোষিত হতে পারে না।
  6. বেশি ডায়েট কন্ট্রোল করলে।
  7. হরমোন-সংক্রান্ত রোগ, যেমন ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকলে
  8. কিডনি রোগের কারনে
  9. কিছু ওষুধের প্রতিক্রিয়া হিসাবে
  10. মারাত্মক পানিশূণ্যতার কারনে

প্রশ্নঃ কোন পরীক্ষার মাধ্যমে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বুঝা যায়?

উত্তরঃ উপরোক্ত উপসর্গগুলো দেখা দিলে রক্ত ও প্রসাব পরীক্ষার মাধ্যমে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বুঝা যায়।

মন্তব্য করুন