আমাদের শরীরের বিষ (Toxin) কি?
আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত বিষ জমছে খাবারের মাধ্যমে, পানির মাধ্যমে, বাতাসের মাধ্যমে-আরো নানা কারনে। জেনে না জেনে প্রতিনিয়ত দেহে বিষ গ্রহন করে চলেছি আমরা। এই বিষক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে দেহটা চলছে খুড়িয়ে খুডিয়ে, কখনো ডেকে আনছে অন্যান্য রোগব্যাধিকে। বা দেহটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে কম্পিউটারের মত।
কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারছিনা। অতি স্বাস্থ্য-সচেতন কিছু মানুষ ছাড়া আমরা প্রায় সবাই জানিই না যে আমরা এক বিষের মহাসাগরে ডুবে আছি এবং এটাকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি, বুঝতে পারছিনা। যেমন একটি মাছ বুঝতে পারেনা যে সে পানিতে বাস করছে।
কিন্তু কি এই বিষ বা টক্সিন?
টক্সিন এক ধরনের জৈব বিষ যা দিনে দিনে শরিরে জমা হতে থাকে। কিন্তু এটা সাপের বিষের মত নয় যে খাওয়া মাত্রই শরীরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। আসলে টক্সিন আমাদের দেহে ধীরে ধীরে জমতে জমতে একসময় বিভিন্ন অঙ্গকে আক্রান্ত করে। ফলে আমরা সেটা তাৎক্ষনিকভাবে বুঝতে পারিনা। টক্সিন দেহ থেকে বের না করলে তা একসময় প্রতিটি কোষকে আক্রান্ত করে এবং জটিল রোগের সৃষ্টি করে। দূষিত খাবার, পানি, বাতাস ইত্যাদির মাধ্যম ছাড়াও আমাদের দেহের মধ্যেও বিভিন্ন কারনে টক্সিন তৈরি হচ্ছে।
টক্সিন (Toxin) কিভাবে সৃষ্টি হয়?
প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি, পানি পান করছি, বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তা থেকে তৈরি হচ্ছে বর্জ্য পদার্থ (Waste materials)। এই বর্জ্য স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহ থেকে বের করে দেওয়ার পদ্ধতি আমাদের দেহের মধ্যেই আছে। তা হচ্ছে আমাদের রেচন যন্ত্র অর্থাৎ ত্বক, মূত্রনালী, মলাশয়, ফুসফুস। ত্বক ঘামের মাধ্যমে, মূত্রনালী প্রসাবের মাধ্যমে, মলাশয় পায়খানার মাধ্যমে এবং ফুসফুস কার্বন ডাই অক্সাইড হিসাবে দূষিত ক্ষতিকর বর্জ্য দেহ থেকে বের করে দেয়।
কিন্তু কোনক্রমে যদি দেহে অতিরিক্ত বর্জ্য জমা হয়ে যায়, যা দেহের পক্ষে বের করে দেওয়া সম্ভব হয়না, সেগুলো বিষ বা টক্সিন (Toxin) হিসাবে দেহে জমা হতে থাকে।
কি কি কারনে দেহে টক্সিন (Toxin) জমা হয়?
যে যে কারনে দেহে টক্সিন জমা হয়, তা স্পষ্টভাবে বুঝে নিন-
- বাজে খাবার এবং প্রসেস্ড ফুড থেকে
- সুগারি (চিনিযুক্ত) খাবার থেকে
- বডিতে খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে কেমিক্যাল ঢুকার ফলে
- বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারনে
- অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরনের ফলে
- পায়খানা ঠিকমত না হওয়া বা কোঠ্যকাঠিন্যের কারনে
- কিডনিতে সমস্যার কারনে
- লিভারের সমস্যা থেকে
প্রশ্নঃ লিভারের সমস্যায় কিভাবে দেহ টক্সিক হয়?
উত্তরঃ লিভার হল এমন অঙ্গ যা সমস্ত দেহকে বিষমুক্ত (Detoxify) করে। কোন কারনে যদি স্বয়ং লিভারেই টক্সিন জমা হয়, তাহলে লিভার আর ডিটক্সিফিকেশনের কাজটা স্বাভাবিকভাবে করতে পারেনা। ফলে লিভারের কারনে দেহ টক্সিক হয়।
কিভাবে বুঝব আমার শরীরে বিষ (Toxin) জমেছে এবং কতটুকু জমেছে?
কিছু কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ (Signs and Symptoms) আছে যার মাধ্যমে দেহে টক্সিনের উপস্থিতি বুঝা যায়। যেমন- কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, অত্যধিক ক্লান্তি, না খেয়েও ওজন বাড়তে থাকা, চর্মরোগ, পেশিতে ব্যাথা, মুড সুইং, অনিদ্রা, পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমা, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ ইত্যাদি। আর সমস্যাগুলো কতটুকু তীব্র তা দ্বারাই টক্সিনের পরিমাণ বুঝা যায়।
প্রশ্নঃ শুধু কি খাবার, পানি আর বায়ুর মাধ্যমেই আমাদের দেহে টক্সিন জমে?
উত্তরঃ না। Stress (মানসিক চাপ), anxiety (দুশ্চিন্তা) থেকেও আমদের শরীর টক্সিক হয়। আবেগের ভারসাম্যহীনতা (Emotional imbalance) থেকেও দেহে টক্সিন জমতে পারে।
এখন আমাদের সামনে প্রশ্ন হল- কিভাবে শরীরকে বিষমুক্ত (Detoxify) করা যায়।
শরীরকে বিষমুক্তকরন (Detoxification) এর পদ্ধতি
এত যে ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়- শরীরে বিষ জমা হওয়া (Toxicity), সেটার প্রতি কি আদৌ আমরা গুরুত্ব দেই? দেইনা। এমন কি আমরা জানিও না যে, শরীরে বিষ জমার মত একটি বিষয় আছে। এই বিষ হল একটি নীরব ঘাতক, যা তিলে তিলে আমাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
তাহলে এবার বুঝে নিন, এই বিষমুক্তকরনের (Detoxification) ব্যাপারে আমাদেরকে কতটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা একটু সাবধান হলেই শরীরকে Detoxify করতে পারি। মনে রাখবেন, এই Detoxification পদ্ধতির সাথে কিন্তু মানসিক এবং আবেগের বিষয়টিও জড়িত। সুতরাং সেগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমদের সক্রিয় প্রচেষ্টা এবং বিষয়টাকে সর্বদা মাথায় রাখা। আর আল্লাহর উপর নির্ভর করা।
এখন আমরা ধাপে ধাপে দেখব, কিভাবে সহজে শরীরকে বিষমুক্ত করা যায় ও বিষমুক্ত রাখা যায়।
লিভারকে ডিটক্সিফাই করা- কফি এনেমা (Coffee Enema) করা
কফি এনেমা হল আপনার নাড়িভূড়ি পরিস্কার করার একটা চমৎকার কৌশল। আমরা জানি আমাদের রোগ ব্যাধির প্রায় ৮৫% ই হয় পেট থেকে। এবং এর সবচেয়ে বড় কারন আপনার পেট পরিস্কার না হওয়া। আপনি হয়ত বলবেন, আমার তো নিয়মিত পায়খানা হয়। নিয়মিত পায়খানা হলেও ভিতরে যে কত বছরের ময়লা আবর্জনা অন্ত্র ও কোলনের গায়ে লেগে আছে, তা আপনি জানেনই না। এর মাধ্যমে দেহটা বিষ হয়ে থাকে, লিভার ভাল করে ফাংশন করতে পারেনা। দীর্ঘকালিন জমে থাকা ময়লা থেকে বিভিন্ন রোগ এমনকি কোলন ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। কোলন হল পরিপাকতন্ত্রের শেষ অংশ।
কফি এনেমা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রক্তনালিতে স্যালাইন দেওয়ার মত করে পায়ুপথ দিয়ে নল ঢুকিয়ে বিশুদ্ধ কফি দানা দিয়ে ফোটানো পানি প্রবেশ করানো হয়। কফির পানি প্রবেশ করানোর ফলে পেটে প্রচন্ড পায়খানার চাপ হয় এবং পুরনো ময়লা বেরিয়ে আসে। কফি এনেমা দৈনিক, সপ্তাহে বা মাসে কতবার নিতে হবে, তার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরন করতে হবে। কফি এনেমা করলে নাড়িভূড়ি পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে লিভারও টক্সিনমুক্ত হয়।
সুস্থ খাবার খাওয়া
সুস্থ লাইফস্টাইল মেনে চলতে গেলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং হল সুস্থ খাবার জোগাড় করে খাওয়া। কেমিক্যালমুক্ত, ফরমালিমমুক্ত, প্রিজার্ভেটিভমুক্ত প্রাকৃতিক খাবার পাওয়া সত্যিই চ্যালেঞ্জের বিষয়। এছাড়া টক্সিসিটি (বিষ) তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে যে খাবার তা হল- প্রসেস্ড-আলট্রা প্রসেস্ড ফুড এবং ভাজা-পোড়া খাবার। এ ধরনের খাবার জোরপূর্বক বাদ দিতে হবে। বিশুদ্ধ, প্রাকৃতিক ও অর্গানিক খাবার খেতে হবে।
কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করা
স্বল্পমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য কে সর্বদা দূরে রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ মত ব্যবস্থা নিতে হবে। কফি এনেমাও হতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমাধান।
খালি পায়ে ঘাসে হাঁটা
খালি পায়ে ঘাসে হাঁটলে শরীর ডিটক্সিফাই হয়। ঘাসে বা মাটিতে হাঁটলে দেহ পৃথিবী থেকে নেগাটিভ চার্জ গ্রহন করে শরীরে জমে থাকা পজিটিভ চার্জকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এতে শরীরে ডিটক্সিফিকেশনের কাজ হয়। খালি পায়ে ঘাসে হাঁটা শরীরের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ভারসাম্য ঠিক রাখতেও ভূমিকা রাখে।
Stress, Anxiety থেকে বের হওয়া
উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ থেকে বডি টক্সিক হয়। ডিটক্সিফিকেশনের প্রয়োজনে এসব নেগেটিভ এনার্জির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ঘুম ঠিক করা
স্পষ্ট কথা, কম ঘুম বা ঘুমের ঘাটতি থেকে শরীর টক্সিক হয়। ঘুমের মাধ্যমে ব্রেইন ও নার্ভাস সিস্টেমের ডিটক্সিফিকেশন হয়।
ঘাম ঝরানো
শারীরিক ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম বা রৌদ্রে যাওয়া যে কোনভাবেই হোক, শরীর থেকে ঘাম ঝরলে ঘামের সাথে বিষাক্ত পদার্থ বা টক্সিন বের হয়ে আসে।
বরফ থেরাপি নেওয়া
বরফ থেরাপি হল, সংক্ষেপে, বরফের পানিতে নির্ধারিত সময়, অর্থাৎ ১/২/৩/৪ মিনিট ডুবে থাকার প্র্যাকটিস। এটা স্ট্রেস (Stress) কমাতে দেহকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। বরফ থেরাপি স্ট্রেস কমানোর মাধ্যমে ডিটক্সিফিকেশনে ভূমিকা রাখে।
রোজা রাখা, Fasting করা
রোজা এবং ফাস্টিং এর মাধ্যমে শরীরে ডিটক্সিফিকেশনের সবচেয়ে বড় কারখানা লিভার নিজেই ডিটক্সিফাই হয়।
শ্বাসের ব্যায়াম, Yoga করা
শ্বাসের ব্যায়াম এবং ইয়োগার মাধ্যমে শরীর রিলাক্সড্ হয়, স্নায়ুবিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়, ভাল ঘুম হয়। আর এভাবে শারীরিক ও মানসিক ডিটক্সিফিকেশন হয়।
ডিটক্স ওয়াটার (Detox Water) পান করা
নিয়মিত ডিটক্স ওয়াটার (Detox Water) পান করা হতে পারে শরীরকে বিষমুক্ত রাখার একটা প্রাত্যহিক রুটিন বাধা কাজ। আপনি যদি ওয়াটার ফাস্টিং করেন, তাহলে আপনাকে ডিটক্স ওয়াটার পান করতে হবে। এছাড়া স্বাভাবিকভাবেও আপনি ডিটক্স ওয়াটার পান করতে পারেন। ডিটক্স ওয়াটার কিনতে পাওয়া যায় বা প্রয়োজনে বাড়িতে নিজেও তৈরি করে নিতে পারেন। এ সংক্রান্ত ভিডিও পাবেন ইউটিউবে।
বেকিং সোডা খাওয়া
শরীরকে ডিটক্সিফাই করার একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা হতে পারে বেকিং সোডা খাওয়া। সাধারন বেকিং সোডা নয়- ফুড গ্রেড বেকিং সোডা আপনাকে খেতে হবে। বেকিং সোডা পেটের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে, শরীরের pH ঠিক রাখতে এবং ডিটক্রিফিকেশনে ভূমিকা রাখে। বেকিং সোডা অবশ্যই নিয়মকানুন মেনে নিয়মমাফিক পরিমাণমত খেতে হবে।
হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট খাওয়া
হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট (Himalayan Pink Salt) একটি চমৎকার ফাংশনাল ফুড। এতে প্রায় ৮০ ধরনের বিভিন্ন খনিজ উপাদান পাওয়া যায়। হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট দেহে খনিজের ঘাটতি পূরন করতে এবং দেহের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখতে নিয়মিত খেতে পারেন। এর মাধ্যমে শরীরের ডিটক্রিফিকেশন ও হয়।
স্পিরিলুনা পাউডার খাওয়া
স্পিরিলুনা পাউডার ও একটি ফাংশনাল ফুড। এটি দেহ থেকে হেভি মেটাল বের করে দিয়ে দেহকে ডিটক্সিফাই করে।
রিলাক্স করা
অতিরিক্ত চাপ (Stress) থেকে রিলাক্স করলে দেহ প্রশান্ত হয়, স্নায়ুগুলো শিথিল হয় এবং এভাবে দেহ ডিটক্সিফাই হয়।
পজিটিভ চিন্তা করা
আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবলে, পজিটিভ চিন্তা করলে মানসিক ডিটক্সিফিকেশন হয়।
সেজদা করা
সেজদার মাধ্যমে গ্রাউন্ডিং হয়। দেহ-মন প্রশান্ত হয়, উত্তেজনা প্রশমিত হয়। সেজদার বাহ্যিক-আধ্যাত্মিক অনেক উপকারিতার মধ্যে দেহের ডিটক্সিফিকেশনও অন্তর্ভুক্ত।