প্রিয় পাঠক, সার্কাডিয়ান রিদ্ম (Circadian Rhythm) কথাটি কি কঠিন শুনাচ্ছে? নাম যাই হোক- X-Y-Z তাতে কি আসে যায়? নামটি দ্বারা আমাদের দেহের কোন বিষয় বা বাস্তবতা (Reality) কে বুঝানো হয়েছে, সেটা শিখে নেওয়াটাই আসল কথা। আমরা একে দেহঘড়ি ও বলতে পারি। আর শাব্দিক অর্থে Circadian Rhythm হল ‘সার্কাডিয়ান ছন্দ’ বা ‘দিনভর চলার ছন্দ’।

যাই হোক, সার্কাডিয়ান রিদ্ম (Circadian Rhythm) সম্পর্কে আপনাকে জানতেই হবে- জীবনের জন্য, সুস্থতার জন্য, প্রশান্তির জন্য। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সার্কাডিয়ান রিদ্ম (Circadian Rhythm) জেনে আপনার স্বাস্থ্য সচেতনতা আরো একধাপ এগিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
দেহঘড়ি (Circadian Rhythm) ব্যপারটা কি?
দুটি ঘটনা বলি-
ঘটনা-১
এক ছাত্র, শিহাব বলেছে, পরীক্ষার দিন সকালে তার মাথা ধরা থাকে। কারন হিসাবে জানা গেল- সে ডে শিফটে পড়ে (১২টা-৫টা), কিন্তু তাকে পরীক্ষা দিতে হয় ৯টা থেকে ১২টা। আর সে কখনো ১১টার আগে ঘুম থেকে জাগেনা। কিন্তু পরীক্ষার সময় তাকে বাধ্য হয়ে ৮টায় উঠতে হয়। সেই কারনে মাথা ব্যাথা। সে স্বীকার করেছে, পরীক্ষা ও দুই ঈদের সময় ছাড়া সে কখনো সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগেনা।
ঘটনা-২
আমার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তাকে সারাজীবন দেখে এসেছি খাওয়া-দাওয়া সেরে এশার পর পর শুয়ে পড়তে এবং ভোরে উঠে মসজিদে গিয়ে ফজর পড়তে। যদি তিনি কখনো দূরবর্তী স্থান থেকে রাতে দেরি করে ফিরতেন (১২টা/০১টা), তবুও সময়মতই মসজিদে গিয়ে ফজর পড়তেন। এখন বলুন-
Circadian Rhythm (সার্কাডিয়ান রিদ্ম) কি তা কি অনুমান করতে পেরেছেন?
তাহলে জেনে নিন, আমাদের দেহের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক, বায়োলজিক্যাল সিস্টেম (System) আছে, যার কারনে দেহ আলো ও আঁধারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে। অন্যভাবে বলতে গেলে দিনকে দিন এবং রাতকে রাত হিসাবে চিনতে পারে। ফলে সেই সিস্টেম রাত হলে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এবং দিন হলে জাগিয়ে দেয়। কোন এলার্ম ঘড়ি লাগেনা। এটাই দেহ ঘড়ি (Circadian Rhythm)।
এই ঘড়ি যে শুধু এই ঘুম-জাগরণ চক্র সম্পন্ন করে তাই নয়; অন্যান্য কাজও করে, যা আমরা পরে জানব।
প্রশ্নঃ এখন প্রশ্ন- দেহ কিভাবে কখন রাত হল আর কখন দিন হল- তা বুঝতে পারে?
উত্তরঃ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান প্রমান করেছে- আমাদের ঘুমের জন্য দায়ি যে হরমোন, “মেলাটোনিন” তা অন্ধকারে নিঃসৃত হয়। আলোতে এর নিঃসরণ (Secretion) ক্ষীণ হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারের মধ্যেও ১০টা থেকে ২টায় মেলাটনিন সিক্রেশনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। এটাই ঘুমের মোক্ষম সময়। ডেল্টা লেভেল ডীপ স্লীপ (Delta-level deep sleep) বা স্বপ্নবিহীন গভীর ঘুম বলতে যা বুঝায়, তা এ সময়েই হয়। এ সময়ের মেলাটোনিন দেহে ঘুমের প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়, যা বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় উপকার সাধন করে। এ সম্পর্কে আমরা পরে জানব।
রাত ২টার পর থেকে মেলাটোনিন ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে এবং দেহে কর্টিসল (Cortisol) হরমোন আসতে থাকে, যা আমাদেরকে জাগিয়ে দেয়।
প্রশ্নঃ এই যে ঘুম-জাগরন চক্র-এ ব্যাপারে ইসলাম কি বলে?
উত্তরঃ চলুন প্রথমে আমরা কোরআনের আয়াত দেখি-
“তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে আবরণ ও নিদ্রাকে আরামপ্রদ করেছেন এবং দিনকে করেছেন জাগ্রত থাকার সময়।” সুরা-ফুরকানঃ আয়াত-৪৭।
“তিনিই নিজ করুনায় তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন; যাতে রাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পার এবং দিনে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার।” সুরা-আল-কাসাসঃ আয়াত-৭৩।
উপরের দুটি আয়াত থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? দেহের যে সৃষ্টিকর্তা, তিনি আমাদের দেহের যে প্রাকৃতিক কাঠামোটি সেটা কিভাবে সঠিকভাবে, সঠিক ছন্দে চলবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং আমাদেরকে তার বিধান জানিয়েও দিয়েছেন। এ বিধান লঙ্ঘন করার মানেই হল আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে উল্টো স্রোতে চলা।
আমাদের রাছুল (সাঃ) যার জীবন-যাপন প্রনালী (Lifestyle) বিশ্ব মানবতার জন্য সর্বদা অনুসরনীয়-অনুকরনীয়; তিনি জীবনভর এশার পর পর ঘুমিয়ে পড়তেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে উঠে তাহাজ্জুদ ও ফজর পড়তেন। আর ইসলামে তো বলতে গেলে সুবহে সাদেক থেকে অর্থাৎ ফজরের আযানের পর থেকে রাতের সমাপ্তি নির্দেশিত হয়। এ সময় ধর্মপ্রান মানুষেরা ঘুম থেকে জেগে নামায পড়বে এবং রাতের সমাপ্তি টানবে ও দিনের সূচনায় কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়বে- এটাই আল্লাহর প্রত্যাশিত।
প্রশ্নঃ কি হবে যদি সময়মত না ঘুমাই বা ঘুমাতে না পারি?
উত্তরঃ বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আপনার দেহের এবং তার ক্রিয়াকান্ডের যে সম্পর্ক তার দাবী আপনি সঠিক সময়ে ঘুমান অর্থাৎ আগে আগে (early) ঘুমাতে যান এবং আগে আগে (early) ঘুম থেকে জাগেন। অর্থাৎ Early to bed and early to rise। ঘুম-জাগরন এই রকম হলে আপনার দেহঘড়ি এই সময়কেই ঘড়ির সঠিক টাইম হিসাবে সেট্ল (Settle) করে নেবে। এবং এই নিয়মেই যথাসময়ে আপনাকে সঠিক ম্যাসেজ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে আর ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবে। যেমনটা আমার বাবার ক্ষেত্রে হয়েছে (ঘটনা-১)।
কিন্তু কোনক্রমে যদি দেহের প্রাকৃতিক ইচ্ছা ও প্রবণতাকে পাত্তা না দিয়ে আপনি দেরি করে ঘুমান আর দেরি করে জাগেন, তাহলে ঘুমের সময় ও জাগার ব্যাপারে আপনার দেহঘড়ি ভুল ম্যাসেজ গ্রহন করবে এবং আজীবন ভুল ম্যাসেজ দিতে থাকবে। যেমনটা ছাত্র শিহাবের ক্ষেত্রে হয়েছে (ঘটনা-২)।
প্রশ্নঃ দেরি করে ঘুমালে বা ঘুম কম হলে কী কী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে?
উত্তরঃ দেরিতে ঘুম, স্বল্প ঘুম, হালকা ঘুম এবং অনিদ্রা বা ঘুমহীনতা একটি বিশ্বব্যপী সমস্যা। এগুলো হল লাইফস্টাইল জনিত রোগ ও বিশৃংখলা (disease or disorder)। ঘুমের এ বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে; যেমন-
- ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immunity) দুর্বল হয়।
- মানসিক চাপ (Stress) বাড়ে।
- হজমের সমস্যা হয়, ফলে গ্যাস্ট্রিক ও IBS এর ঝুঁকি বাড়ে।
- মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমতে থাকে।
- ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়।
- ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অস্থিরতা বাড়ে, মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হয়।
প্রশ্নঃ ঘুমের বিশৃংখলা ঘটলে তার সমাধান কি? বা সার্কাডিয়ান রিদ্ম কিভাবে ঠিক করা যায়?
উত্তরঃ অভ্যাসের প্যাটার্নে বন্দি হয়ে গেলে তার থেকে বের হওয়া সহজ নয়। সার্কাডিয়ান রিদ্ম বিশৃংখল হয়ে পড়লে, তা ফিরিয়ে আনা কারো জন্য ৪০ বৎসরও যথেষ্ট নাও হতে পারে, যদি না তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়। আপনি কি এমন লোক দেখেননি যে সারা বছরই নামায পড়ে, শুধু ফজরের নামাযটি ছাড়া। সুতরাং প্রবল আগ্রহ ও প্রচেষ্টা থাকা চাই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে। আর সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে তার উপর ভরসা রাখতে হবে (তাওয়াককুল)।
আর একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে, যে পদ্ধতিতে অনেকেই সফল হয়েছেন, সার্কাডিয়ান রিদ্ম ঠিক করতে পেরেছেন। আপনিও চেষ্টা করুন, অবশ্যই সফল হবেন। পদ্ধতিটি হল- জোর করে কয়েকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠুন। জোর করেই, কারন- আপনাকে তো যুদ্ধে জিততে হবে। মনে রাখবেন, জোর করে ঘুমানো যায়না, কিন্তু জোর করে উঠা যায়। প্রয়োজনে এলার্ম ঘড়ির সাহায্য নিন। কয়েকবারের পদক্ষেপ ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু ছেড়ে দেবেননা।
দিনের বেলা ঘুমের প্রবল চাপ হবে, কিন্তু ঘুমাবেননা কিছুতেই। ভোরে উঠে হাঁটাহাটি করুন, ব্যায়াম করুন। জেগে থাকার সময়টা ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত করে নিন। রাত ১০ টার পূর্বেই বিছানায় যান। গাঢ় অন্ধকার ও শব্দহীন রুমে আরামদায়ক বিছানায় ঘুমান। জেগে থাকার দীর্ঘ সময় এবং সকালের ব্যায়ামের ক্লান্তি আপনার ঘুম এনে দেবে। প্রথম সপ্তাহে সফল নাও হতে পারেন। এভাবে একমাস চালিয়ে যান। একদিন সার্কাডিয়ান রিদ্ম সঠিক ছন্দে চলতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্নঃ দেহঘড়ি বা Circadian Rhythm এই ঘুম-জাগরন চক্র ছাড়া আর কি কি কাজ করে?
উত্তরঃ ঘুম-জাগরন চক্র ছাড়াও সার্কাডিয়ান রিদ্ম মানবদেহের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পন্ন করে; যেমন- হরমোন নিঃসরন, ক্ষুধা এবং হযম, তাপমাত্রা ইত্যাদি।
প্রশ্নঃ দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদ্ম দেহের কোথায় কিভাবে অবস্থান করে?
উত্তরঃ সার্কাডিয়ান রিদ্ম এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো ঘড়ি আছে যা দেহের বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে। একটি প্রধান ঘড়ি জীবের সমস্ত জৈবিক ঘড়িকে সমন্বয় করে। সেই প্রধান ঘড়িটি থাকে মস্তিষ্কে। মানবের প্রধান ঘড়িটি প্রকৃতপক্ষে স্নায়ুকোষের একটি বৃহৎ গ্রুপ যা সুপ্রাকিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস নামে একটি গঠন তৈরি করে ঘড়িগুলোকে পরিচালনা করে।
প্রশ্নঃ সার্কাডিয়ান রিদ্ম (Circadian Rhythm) কি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই চলে?
উত্তরঃ না, অন্যান্য প্রাণি এবং উদ্ভিদেরও সার্কাডিয়ান রিদ্ম আছে।
ধন্যবাদ!!