আপনি দিন-রাত কাজের চাপের মধ্যে আছেন, পরিশ্রম বেশি হচ্ছে, মানসিক স্ট্রেস ম্যানেজ করতে পারছেননা- এর জন্য ক্লান্ত হচ্ছেন। আমি এ ধরনের ক্লান্তির কথা বলছিনা। এ ধরনের ক্লান্তি হয়ত সহজেই দূর হতে পারে- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে, কাজের চাপ কমে গেলে এবং রিলাক্স করলে।
আমরা এখানে ফোকাস করতে যাচ্ছি- দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তির কথা, যার পেছনে বিভিন্ন রোগ এবং শারীরিক সমস্যা ও জটিলতার ইতিহাস জড়িত। পর্যাপ্ত বিশ্রামেও যা দূর হয়না। দিন-রাত সারাক্ষণ অবসন্ন, নির্জীব ও শক্তিহীন মনে হয়। কিন্তু তা বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন (Depression) নয়।
তাহলে দেখে নিই কি কি কারনে আমরা এই দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিতে ভুগি-
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি কেন হয়?
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির তিন ধরনের কারন হতে পারে- মানসিক কারন, রোগজনিত কারন এবং লাইফস্টাইলজনিত কারন
মানসিক কারন (Mental factors)
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি রোগ যা থেকে হতে পারে তা হল- দীর্ঘস্থায়ী টেনশন, মানসিক স্ট্রেস, কাজের চাপ ও বিপদাশংকা বা উৎকণ্ঠা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, টেনশন অনেকের জীবনের সাথে মিশে গেছে। টেনশনের বিষয়টি অনেকের জীবনে ‘অটো’ হয়ে গেছে। তারা বলে যে, টেনশন করতে হয়না, টেনশন এসে যায়। অর্থাৎ টেনশন তারা করেনা, টেনশনই তাদেরকে কিছু একটা করে; টেনশনকে তারা নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা, টেনশনই তাদেরকে নিয়ন্ত্রন করে।
এরকম অবস্থায় যাদেরকে পেয়ে বসেছে, তারাই দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি রোগে আক্রান্ত।
কিন্তু বাস্তবতা হল, এই ধরনের সমস্যা নিয়ে আপনি সচরাচর ডাক্রারের কাছে যাননা। যদি অন্য কোন অসুখ নিয়ে যান, আর ডাক্তার বুঝে যে, আপনার ক্লান্তি-দুর্বলতা আছে, তাহলে হয়ত আপনার জন্য প্রেসক্রাইব করা হবে- ভিটামিন ট্যাবলেট অথবা এন্টিডিপ্রেসেন্ট বা ‘বিষণ্ণতার ওষুধ’ যা ঘুম বৃদ্ধিতে সহায়ক। কিন্তু এভাবে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি থেকে সেরে উঠা আপনার কপালে জুটবেনা।
রোগজনিত কারন (Causes from diseases)
কিছু অসুখ ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা আপনার দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির কারন হতে পারে, যেমন- যকৃতের প্রদাহ (Liver inflamation), উচ্চ রক্তচাপ, রক্ত স্বল্পতা, কিডনি রোগ, এইচাআইভি সংক্রমন, যক্ষ্মা, থাইরয়েডের অবস্থা ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবতা হল, আপনি এই ধরনের অসুখে বা জটিলতায় পড়লে এই রোগের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টে যান, তাতেই দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির চিকিৎসা হয়ে উঠেনা।
লাইফস্টাইলজনিত কারন (Lifestyle factors)
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির অসুখ থেকে সেরে উঠতে প্রতিদিনের জীবনযাপন পদ্ধতি (Daily lifestyle) তে আপনার কি কি পরিবর্তন আনতে হবে বা আপনি কি কি করবেন- সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এগুলির উপরেই ফোকাস করব। মনে রাখবেন, লাইফস্টাইলের এই নিয়মগুলি অনুসরন করলে আপনার মানসিক সমস্যা, যেমন- উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, স্ট্রেস- এগুলিও নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। কারন মানসিক অনেক বিষয়ের সাথেই দৈহিক কারন জড়িত, যা হয়ত আমরা জানিনা বা জানলেও গুরুত্ব দেইনা।
এছাড়া, এ নিয়মগুলো যে শুধুমাত্র দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি দূর করতেই প্রয়োজন, তা কিন্তু নয়, এগুলো আপনার নিয়মিত অনুসরনীয় লাইফস্টাইলেরই অংশ।
তাহলে জেনে নিই, লাইফস্টাইলজনিত কি কি কারনে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সৃষ্টি হয় এবং আমাদের করনীয় কি-
➤ অতিরিক্ত চাপ (Excessive stress)
অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক চাপ আপনার দেহ-মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। এটাই ক্লান্তি। কাজের চাপের ক্ষেত্রে আমাদের যে সাধারন সমস্যা, সেটা হল কাজকে অর্থাৎ বর্তমান ও আসন্ন কাজকে ম্যানেজ করার ব্যর্থতা।
আমি একবার মাথার সমস্যা নিয়ে এক মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম আমার প্রচন্ড কাজের চাপের কথা। শুনে তিনি বলেছিলেন, আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর তো কাজের চাপের কারনে মাথাব্যাথা হয়না। হক কথা!
সুতরাং কাজকে সুযোগ দেওয়া যাবেনা যাতে সে চাপ প্রয়োগ করে আপনাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। আপনি কাজের উপর চাপ প্রয়োগ করুন। কাজকে ম্যানেজ করুন- শুধু দৃশ্যমান কাজের চাপকেই নয়, মানসিক কাজের চাপকেও।
নিঃশ্বাসের ব্যায়াম যান্ত্রিকভাবে আপনার দৈহিক-মানসিক চাপকে কমিয়ে দেয়। নিয়মিত নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করুন।
➤ ঘুমের ঘাটতি (Sleep deficiency)
ঘুমের ঘাটতি নীরবে ধীরে ধীরে আপনার দেহে অনেক ঘাতক ব্যাধির সৃষ্টি করে। ১/২ দিন বা এক সপ্তাহের ঘাটতি নয়, বছরের পর বছর ধরে যদি আপনার দেহে ঘুমের ঘাটতি থাকে, তাহলে কিন্তু এটাকে আপনি ঘাটতি বলে মনে করবেননা, এটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর বাস্তবতা।
দীর্ঘ ঘুমের ঘাটতি থেকে ক্যান্সার, টিউমার, ব্রেইনের জটিলতা সহ অনেক মারনব্যাধি সৃষ্টি হয়, দেহে স্থায়ী ক্লান্তি ও দুর্বলতা বাসা বাঁধে।
সুতরাং উন্নত ঘুম শুধু ক্লান্তি দূর করার জন্যই নয়, আপনার সামগ্রিক লাইফস্টাইলের একটি আবশ্যকীয় শর্ত। ঘুমের যত্ন নেওয়াকে আপনার দৈনন্দিন কাজের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করুন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের দৈনিক ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন।
➤ অতিরিক্ত ওজন (Over-weight)
অতিরিক্ত ওজন যেমন ডায়াবেটিস, রক্তনালির ব্লক, হার্টস্ট্রোক, ব্রেইনস্ট্রোক সহ অনেক অনেক ভিআইপি রোগের জন্য দায়ী, তেমনি দায়ী আপনার দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির জন্য। আপনার যদি ফ্যাট বা কোলেস্টেরলজনিত অতিরিক্ত ওজন থাকে এবং ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্স হয়, তাহলে দেহ আপনার সঞ্চিত চর্বি খরচ করে শক্তি উতপাদন করতে পারেনা। ফলে আপনি শক্তি পাননা, দুর্বল ও ক্লান্তি বোধ করেন।
সুতরাং শুধু দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি দূর করার জন্য নয়, অনেক অনেক জীবনবিনাশি রোগ থেকে বাঁচতে আপনার ওজন কমানো প্রয়োজন।
➤ ক্যালরির অভাব (Lack of calorie)
শুধু ওজন বেশি হওয়া নয়, ক্যালরির ঘাটতিতেও দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির সৃষ্টি হয়। ক্যালরির সাময়িক অভাব নয়, দীর্ঘদিন ধরে শরীরে ক্যালরির অর্থাৎ শর্করা, ফ্যাট, প্রোটিনের ঘাটতি থাকলেও আপনাকে স্থায়ী ক্লান্তিতে পেয়ে বসবে।
সুতরাং নিয়মিত ক্যালরির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে কিনা, সেটা হিসাবে রাখা আপনার দৈনন্দিন স্বাস্থ্য চর্চারই একটি অংশ।
➤ ভিটামিনের ঘাটতি (Vitamin deficiency)
ভিটামিনের ঘাটতি আপনার ক্লান্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী, বিশেষ করে- ভিটামিন ডি ও বি১২। ভিটামিন ডি ইমিউনিটি ও তারুন্য বৃদ্ধি করে। ভিটামিন বি১২ লোহিত রক্তকনিকার উৎপাদন ও স্নায়ুর কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজন। দুটোরই অভাবে শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি দেখা দেয়। এছাড়া এগুলোর অভাবে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, পেশির দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
আমরা সচরাচর সচেতনভাবে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বেছে বেছে খাইনা। আমাদের দৈনন্দিন খাবার, বিশেষত শাকসব্জি ও ফলমূল থেকেই বেশিরভাগ ভিটামিনের যোগান হয়। সুতরাং আমাদেরকে শাকসব্জি ও ফলমূল নিয়মিত খেতে হবে। বিশেষ কোন ভিটামিনের ঘাটতি হলে ইচ্ছে করলে সাপ্লিমেন্টও নিতে পারি। ভিটামিন ডি ও ভিটামিন বি১২ উভয়েরই সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়।
সূর্যের আলো ভিটামিন ডি এর প্রাকৃতিক উৎস। এছাড়া তৈলাক্ত মাছ, সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, মাশরুম, দুধের সর, পনির ইত্যাদিতে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায়- দুগ্ধজাত খাবার ও ডিমে।
➤ খনিজের ঘাটতি (Minerals deficiency)
খনিজ লবনের ঘাটতি, বিশেষ করে আয়রন ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতির দেহে স্থায়ী ক্লান্তি ভর করার অন্যতম কারন। ভিটামিনের মত খনিজ লবনও আমরা সচেতনভাবে খাইনা। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য থেকেই পেয়ে থাকি। কিন্তু দেহে কোন লবনের ঘাটতি থেকে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হলে বুঝা যায় যে আমরা কি খাইনি।
আয়রন ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি আমরা খাদ্য থেকে পূরণ করতে পারি। মুরগির মাংস এবং সামুদ্রিক খাবারে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে। কলিজা আয়রনের একটি ভাল উৎস। এছাড়া ছোলা, কচুশাক, পালংশাক, ডাল ইত্যাদিতেও আয়রন পাওয়া যায়। আবার ম্যাগনেসিয়ামের ভাল উৎস হল- বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার। এ ছাড়াও পালংশাক, কলমি শাক, সবুজ শাক, ডাল, সয়াবিন, ছোলা থেকে ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়।
➤ শরীর চর্চা না করা (Avoiding physical exercise)
শরীর চর্চা বা শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতার কথা তো আমরা সবাই জানি। আপনি যে কোন লাইফস্টাইল মেনে চলেননা কেন- শারীরিক ব্যায়াম হবে তার আবশ্যকীয় শর্ত। ব্যায়াম না করলে দেহটাতে মরিচা ধরে এবং একটা জং ধরা বা মরিচা পড়া ছুরির মতই ধীরে ধীরে অকেজো হতে থাকে। ফলে সমস্ত বড় বড় রোগগুলি এসে দেহে ঘাটি গাড়তে থাকে। ব্যায়াম সম্পর্কে আমাদেরও আছে বিস্তারিত আয়োজন, তাই এখানে বিস্তারিত বলা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি।
ব্যায়াম না করাটা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির সবচেয়ে বড় কারন। জীবনের প্রয়োজনে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
➤ মানসিক প্রশান্তির চর্চার না করা (Avoiding Mental exercise)
মানসিক প্রশান্তি না থাকা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির একটি বড় কারন। দেহ থেকে মনকে আলাদা করা যায়না। আমার প্রিয় লেখক এস. এম. জাকির হোসেন বলেছেন, “ডাক্তারদের সবচেয়ে বড় ভুল এই যে, তারা দেহকে চিকিৎসা করেন মনকে বাদ দিয়ে।” ফলে যা হবার তাই হয়। মানুষের শত সমস্যা আছে যা মানসিক। এই সমস্ত মানসিক সমস্যা দৈহিক অবস্থাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। অথচ ডাক্তারি বিদ্যায় এগুলো শিখানো হয়না।
মানসিক প্রশান্তির চর্চা আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সব ধরনের ক্লান্তিকে দূর করে দিতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হল- ভোরে হাঁটতে বেরোনো, খালি পায়ে ঘাসে হাঁটা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া, সুস্থ বিনোদন, আনন্দদায়ক খেলাধুলা, ভাল টোরিস্ট স্পটে বা গ্রামে বেড়াতে যাওয়া, নিঃশ্বাসের ব্যায়াম, নিয়মিত নামায পড়া, প্রার্থনা করা, কল্যানমূলক কাজ করা, পজিটিভ চিন্তা করা ইত্যাদি।