প্রশান্তির জন্য শিখিঃ কোষ কী?/আমাদের দেহের কোষ জিনিসটি দেখতে কেমন?

স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কথাবার্তায় আমরা প্রায়শই শুনে থাকি ‘কোষ’ এর কথা। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরেরও একটি কমন ডায়লগ- “ডায়াবেটিস নির্মূলে কোষ খালি করতে হবে।” কিন্তু কি এই কোষ যা আমাদের দেহে থাকে? আমরা অনেকেই জানিনা। না জেনেও আমরা মনে মনে কল্পনায় কোষের একটা ছবি এঁকে নিই। কেউ ভাবি, হয়ত কাঠালের কোষের মত কিছু একটা হবে। না বন্ধুরা, দেহের কোষ মানে ভিন্ন একটি বিষয় যা জানা আপনার অবশ্য প্রয়োজন জীবনের জন্য, সুস্থতার জন্য, প্রশান্তির জন্য। তাহলে চলুন জেনে নিই কোষ কি? সহজ কথায়, আপনার নিজের মত করে, ঘরোয়া ভাষায়।

কোষ কি?

আমাদের দেহের যে কোষ, তার সাথে ‘কাঠালের কোষ’ এর সামান্যই মিল আছে। আমাদের দেহের কোষকে তুলনা করা যেতে পারে একটি বিল্ডিং এর ইটের সাথে। একটি বিল্ডিং যেমন অনেকগুলো ইট দ্বারা গঠিত, তেমনি আমাদের দেহটা অনেক অনেক কোষ দ্বারা গঠিত। কিন্তু ইট দেখা গেলেও আমাদের দেহের কোষ কিন্তু খালি চোখে দেখা যায়না, অনুবীক্ষন যন্ত্র ছাড়া। একটি সূঁচের মাথায় যে বিন্দু পরিমাণ পানি ধরে তার চেয়েও বহুগুন ক্ষুদ্র আমাদের কোষ। একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের দেহে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ রয়েছে। আমাদের মাংস (মাংসপেশী), হাড়, মগজ, ত্বক (চামড়া), রক্ত ইত্যাদি সবই কোষ দ্বারা গঠিত।

কী বিস্ময়কর, তাইনা?

আমাদের কারো ওজন ৫০ কেজি, কারো ৬০, ৭০, ৮০ বা ১০০ কেজি। এই পুরো বডিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের দেহের বাইরে থেকে যা দেখা যায় অর্থাৎ দেহের মাংস বা মাংসপেশী-এগুলো যেমন কোষ দ্বারা গঠিত, তেমনি হাড়, ব্রেইন, লিভার, ত্বক (চামড়া), রক্ত, স্নায়ু ইত্যাদিও কোষ দ্বারা গঠিত। তবে আলাদা আলাদা রকমের কোষ দিয়ে গঠিত। কিছুটা আলাদা হলেও সব ধরনের কোষের আছে কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য। যাই হোক, একই প্রকারের কোষের (ধরা যাক, মাংশপেশীর কোষের) আকার, গঠন ও কাজ একই রকমের। আর আমরা এখানে প্রধানত মাংশপেশীর কোষ নিয়েই কথা বলব।

জেনে রাখুন,

মাংসপেশীর একটিমাত্র কোষের গঠন ও কাজ যেরকম, সবগুলি কোষের গঠন ও কার্যাবলি একই রকম হওয়ায়, যে কোন একটি কোষের অবস্থা জেনে, মোটামুটি সকল কোষের অবস্থা জেনে ফেলা যায়। আবার একটি কোষের সুস্থতা-অসুস্থতার উপরে কিন্তু পুরো দেহের সুস্থতা-অসুস্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

লক্ষ করেছেন কি?

ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) হলে বা আমরা যখন রোজা রাখি, তখন বিকালের দিকে শরীরে পানি-স্বল্পতা দেখা দেয়। এটা ঘটে, কারন- দেহের মধ্যকার রক্তনালী ও কোষ থেকে অনেক পানি বেরিয়ে যায়। ফলে শরীর শুকিয়ে যায়। আবার যখন পানি পান করি, তখন রক্তনালীর ভিতর দিয়ে আবার কোষে কোষে পানি পৌঁছে যায়। এবং আমরা স্বস্তি বোধ করি।

প্রশ্নঃ এখন প্রশ্ন হল- এত যে ক্ষুদ্র কোষ, এটা দেখতে কেমন বা এর ভিতরে কি ফাঁকা?

উত্তরঃ মোটেই নয়। ফাঁপা তো নয়ই বরং এর ভিতরে রয়েছে ১৫-২০ টার মত বিভিন্ন ধরনের জিনিস (অঙ্গানু)। যাদের নামগুলোও চমৎকার, যেমন- নিউক্লিয়াস, সাইটপ্লাজ্‌ম, মাইটোকন্ড্রিয়া, লাইসোজোম, সেন্ট্রোজোম, গলজি বস্তু ইত্যাদি। এছাড়া নিউক্লিয়াসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ক্রোমোজোম। এবং এদের প্রত্যেকটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা রকমের কাজ। এক বিশাল কারখানা আর কি!

কি মাথা ঘুরছে? হ্যাঁ, তবে এটাই সত্য।

প্রশ্নঃ এখন প্রশ্ন, কোষই তো ক্ষুদ্র, আবার তার ভিতরের এত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসগুলো কিভাবে দেখা যায়?

উত্তরঃ এগুলিকে দেখার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালি মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয় (ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ), যার মাধ্যমে একটি জিনিসকে ১০০০০ গুণ বা তারও বেশি বড় করে দেখা যায়। তখন একটি কোষকে দেখতে নিচের ছবির মত হবে-

কোষঃ চোখ বন্ধ করে ভাবুন

উপরের ছবিটির দিকে এক মিনিট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। এবার চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন তো দেখি, এরকম অনেকগুলো অঙ্গানু নিয়ে এমন কোটি কোটি, বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ ইটের মত স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে আমাদের দেহের বিল্ডিংটি তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহর কী অপূর্ব সৃষ্টি!

আরো ভাবুন, এই সবগুলি কোষ সৃষ্টির শুরু থেকে রাত-দিন বিরামহীন কাজ করে চলেছে। চোখ বন্ধ করে কল্পনায় আরো দেখুন, সবগুলি কোষে অজস্র স্রোতধারায় রক্তনালি বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের খাওয়া খাদ্যের খাদ্যরস, পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে নেওয়া অক্সিজেন। আবার কোষের ভিতরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন) ইত্যাদি রক্তনালি বাহিত হয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের রেচন যন্ত্র (কিডনি, ত্বক) এগুলোকে ফিল্টার (Filter) করে পাঠাচ্ছে প্রসাব, ঘাম আকারে। তার মানে বিশালাকার ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ওয়ার্ক।

কোষের যত বিচিত্র কাজ

কোষের প্রধেন কাজ হল তিনটি- ১. দেহ গঠন করা ২. বিপাকীয় কাজ করা (জীবদেহের রাসায়নিক বিক্রিয়া) ৩. বংশগতির তথ্য ধারন করা

দেহ গঠন

শিশুকালে আমাদের দেহটা ছোট ছিল; ধীরে ধীরে দেহটা বড় হয়েছে। একথার অর্থ হল দেহে কোষের বৃদ্ধি ঘটেছে। কোন কোষের বৃদ্ধি ঘটেছে? সব কোষের। মাংশপেশীর কোষের, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। এছাড়া যা বাইরে থেকে দেখা যায়না সে সমস্ত কোষেরও, যেমন- হাড়ের কোষ, রক্ত কোষ, স্নায়ু কোষ ইত্যাদি। এভাবে কোষ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেহের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে।

কিভাবে কোষের বৃদ্ধি ঘটে?

স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিনিয়ত কোষ থেকে কোষের সৃষ্টি হচ্ছে। পুরনো কোষ মরে যাচ্ছে, নতুন কোষ সৃষ্টি হচ্ছে। মৃত কোষ কখনো অটোফেজি (Autophagy) প্রক্রিয়ায় দেহে থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কখনো আবর্জনা বা টক্সিন হিসাবে দেহে জমা হচ্ছে।

খাদ্যের যে উপাদানটি থেকে আমাদের দেহে কোষ তৈরি হচ্ছে, তা হল প্রোটিন বা আমিষ। সুতরাং প্রোটিন বা আমিষ সঠিক পরিমাণে খেলে আমাদের দেহের বৃদ্ধি ঘটবে বা সুস্থভাবে দেহের ওজন বৃদ্ধি পাবে।

জেনে রাখুন, লক্ষ করেছেন কি-অনেক সময় দেহে ময়লা না থাকলেও আঙ্গুল দিয়ে ঘষা দিলে ময়লার মত কিছু উঠে আসে; এগুলো হল মৃত কোষ। সাধারণত জ্বর বা দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এমন হয়।

বিপাকীয় কাজ

আমরা যে খাদ্য খাই, তার সারাংশ অর্থাৎ পুষ্টির যে অংশ দেহে ব্যবহৃত হওয়ার পর অতিরিক্ত থাকে, তা শক্তি (চর্বি) আকারে কোষে জমে থাকে। পরবর্তীতে দেহে শক্তির ঘাটতি হলে এই শক্তি থেকে ব্যয়িত হয়।

এছাড়া রক্তের মাধ্যমে কোষে অক্সিজেন পরিবাহিত হয়, আবার কোষ থেকে বিষাক্ত দ্রব্য ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেহের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পৌঁছে। এভাবে কোষ বিভিন্ন ধরনের বিপাকীয় কাজে অংশগ্রহন করে।

বংশগতির তথ্য ধারন

সন্তান দেখতে পিতা বা মাতার মত হয়। এছাড়া পিতামাতার উচ্চতা, গায়ের রং, আচরন, স্বভাব, রোগব্যাধি ইত্যাদিও পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। বংশ-পরম্পরায় কিভাবে পরবর্তী প্রজন্ম পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য পায়? এই বৈশিষ্ট্যগুলো দেহের কোথায় সংরক্ষিত থাকে? উত্তর হল- কোষে। ক কোষের নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোমের জিন (Zene) এ থাকে এ বৈশিষ্ট্য-নির্ধারক তথ্যগুলো।

কোষ কিভাবে সমগ্র দেহের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে?

প্রধানত রক্তনালির মাধ্যমে। আমাদের সমগ্র দেহটি মাইলের পর মাইল ব্যাপি লম্বা রক্তের শিরা-উপশিরা ধমনী-উপধমনীর নেটওয়ার্ক দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত।

আমরা হাত টান করলে, দেহের একটি বড় রক্তনালি (শিরা) দেখতে পাই। কিন্তু শিরা বা রক্তনালি যে কেবল এরকম মোটা তা কিন্তু নয়। এটা বাসায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের তারের মত মোটা হতে পারে; আবার সরু হতে হতে চুলের মত সূক্ষ্মও হতে পারে। তার মানে- শিরা-ধমনীগুলো সরু হতে হতে ওগুলো থেকে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি হয়ে কোষীয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ রক্তনালির নেটওয়ার্ক কোন না কোনভাবে প্রতিটি কোষে পৌঁছে গেছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোষ দেহ থেকে কোন কিছু গ্রহন করে বা দেহে বা দেহের বাইরে কোন কিছু ত্যাগ করে।

এই নেটয়ার্কের মাধ্যমেই খাদ্যরস, পানি বা যে কোন তরল পদার্থ, অক্সিজেন কোষে কোষে পৌঁছে যায়। এমনকি কোষের সমস্যার কারনে দেহ অসুস্থ হলে- আমাদের পান করা ওষুধ এবং ইঞ্জেকশন এই নেটওয়ার্ক ধরেই প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায়।

প্রশ্নঃ প্রতিটি কোষ কিভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে?

উত্তরঃ কোষের পৃষ্ঠের দিকে আনুগত্য অণু (CAMs) নামের এক ধরনের বিশেষ অণু আছে। এর মাধ্যমে একটি কোষ তার প্রতিবেশি কোষগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকে এবং যোগাযোগ রক্ষা করে। আনুগত্য অণু ছাড়াও কোষ-পৃষ্ঠের প্রোটিন অনুও সংযোগ রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করে। আনুগত্য অণু হল বিল্ডিং ব্লককে সংযুক্তকারী মর্টার বা এক ধরনের পেস্ট এর মত, যা অনুগুলোকে বিভিন্ন আন্তঃকোষীয় জংশন সৃষ্টি করে বেধে রাখে।

কোষ সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য

  1. সকল জীবই (উদ্ভিদ ও প্রানি) এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত। মানুষের দেহে যেমন আছে ট্রিলিয়ম ট্রিলিয়ন কোষ, আবার এক কোষ দিয়ে গঠিত জীবও আছে। অ্যামিবা হল এককোষী জীব।
  2. আমাদের সামনে দৃশ্যমান কোষ হল ডিম। আস্ত ডিমটি হল একটি কোষ। এর থেকে জন্ম নেয় একটি প্রানি। উট পাখির ডিম হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোষ। একটি ডিম থেকে যেমন একটি প্রানির সৃষ্টি হয়, মানুষ বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রানির জন্মও কিন্তু হয় পুরুষের একটি কোষ (শুক্রানু) এবং নারীর একটি কোষ (ডিম্বানু) এর মিলনের ফলে। তবে সেই কোষ দেহের কোন কোষ নয়, সেগুলো হল যৌনকোষ।
  3. জীবের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ সব ক্রিয়াই কোষের অভ্যন্তরে সংঘটিত হয়।
  4. কোষের ক্রোমোজোমের ডিএনএ (DNA) হল বংশগতির ধারক। অর্থাৎ ডিএনএ বংশগতির তথ্য ধারন করে। ডিএনএ এর জিন (zene) কে পরিবর্তন করে একটি জীবের গঠন-বৈশিষ্ট্য পালটে ফেলা যায়। এভাবেই তৈরি হচ্ছে হাইব্রিড ফলমূল, শাকসব্জ, হাইব্রিড হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদি।
  5. কোষকে একটা ইন্ডাস্ট্রির সাথে তুলনা করা যায়। সেই ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু মেশিন কিছু শক্তি তৈরি করে, আবার কিছু মেশিন খাদ্য- যেমন প্রোটিন তৈরি করে, কোনটি কোষের ময়লা-আবর্জনা জমা রাখে, কোনটি খাবার প্রসেস করে, কোনটি আবার প্যাকেজ করে ইত্যাদি।

মন্তব্য করুন