পেট ও অন্ত্রের রোগসমূহ- সহজে চিনে নিন- জীবনের জন্য, সুস্থতার জন্য, প্রশান্তির জন্য

পেট ও অন্ত্রের রোগ

আমাদের দেহে সর্বমোট এগারোটি প্রধান তন্ত্র বা সিস্টেম (system) রয়েছে। আপনি যদি সর্বপ্রথম অন্ততঃ একটি তন্ত্র সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে সেটা হওয়া উচিত পরিপাকতন্ত্র বা Digestive System। অর্থাৎ পরিপাকতন্ত্রই সবার আগে অগ্রাধিকার পাবে। পরিপাকতন্ত্র হল আমাদের দেহের এমন একটি তন্ত্র যার সম্পর্কে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাইই কমবেশি ধারনা রাখে। আমরা খাদ্য খা্ই- সেই খাদ্য পেটে যায়- পেটে গিয়ে হযম হয়- তারপর পায়খানা হয়ে বের হয়। হযম ঠিকমত না হলে পেটে গ্যাস হয়, পেট জ্বলে, পাতলা পায়খানা হয়, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হয় ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে ধারনা থাকা সত্ত্বেও আমরা পরিপাক তন্ত্রের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা সম্পর্কে কিন্ত তেমন কিছুই জানিনা।

কিন্তু পরিপাকতন্ত্র সম্পর্কে আপনাকে জানতেই হবে। আপনার দেহের প্রায় ৮৫% রোগের সাথে পরিপাকতন্ত্রের সম্পর্ক আছে। সাধারনভাবে আপনি এই কথার উপর ভরসা রাখতে পারেন- সুস্থ পরিপাকতন্ত্র মানেই সুস্থ জীবন।

আমাদের পরিপাকতন্ত্র কি এবং কিভাবে কাজ করে- এ সম্পর্কে সহজবোধ্য ভাষায় আমরা উপস্থাপন করেছি নিচের পোস্টটিতে। এখনই দেখে নিন-

পড়ুনঃ আমাদের খাদ্য পরিপাক বা হযম আসলে কি? সহজে শিখে নিন সুস্থতার প্রথম পাঠ।

এই পোস্টে আমরা পরিপাকতন্ত্রের রোগগুলোর উপরে ফোকাস করব। আপনার জীবনের প্রয়োজনে, সুস্থতার প্রয়োজনে রোগগুলো সম্পর্কে একটি সাধারন ধারনা নিয়ে নিন। ১০ মিনিট সময় ব্যয় করে পড়ে নিন, নিঃসন্দেহে আপনি স্বাস্থ্য সচেতনতায় একধাপ এগিয়ে থাকবেন।

পরিপাকতন্ত্রের রোগসমূহ

আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে ঘিরে কেন এত রোগ? আমাদের দেহে যে যে জিনিস প্রবেশ করে দেহের মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়, সেগুলো হল- পানি, বায়ু, শব্দ, গন্ধ, খাদ্য ইত্যাদি। এর মধ্যে দেহে সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় যে জিনিসটি সেটা হল- খাদ্য। বলা নিষ্প্রয়োজন এই পরিবর্তনের প্রবনতা ভালর দিকে নয়, খারাপের দিকে। আজ বিশ্বে না খেয়ে মারা যাওয়ার চেয়ে খেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা কয়েকগুন বেশি।

কেন খাওয়ার মাধ্যমে রোগে হওয়ার এবং মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে? কারন- মানুষ খাওয়ার সময় পেটের সাথে পরামর্শ করে খায়, জিহ্বার সাথে পরামর্শ করে খায়, নাকের সাথে পরামর্শ করে খায়, চোখের সাথে পরামর্শ করে খায়। কিন্তু আগে সে রক্তনালি, হার্ট, লিভার, ব্রেইন, দেহের কোষ- এসবের সাথে পরামর্শ করে খায়না। ফলে সে তা-ই খায়, আল্লাহর সৃষ্টি করা দেহটা যার ভার বহন করতে পারেনা।

মহান আল্লাহ, যিনি এই দেহের এবং একই সাথে মানুষের মনের নফসের সৃষ্টিকর্তা, তিনি জানেন যে- মানুষ এই খাবারের সাথে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবেনা। আর সে কারনেই তিনি দিয়েছেন রোজার বিধান। যার যৌক্তিকতা, প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকারিতা এই সর্বাধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগে আরো বেশি পাকাপোক্তভাবে প্রমানিত হয়েছে।

যাই হোক, আমরা এই স্টেপে পেট বা পাকস্থলি ও অন্ত্রের সাধারন রোগগুলোর ব্যাপারে সাধারন ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করব- সাধারন পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনে। রোগগুলো বিস্তারিত বিবরন এখানে পাওয়া যাবেনা। আর সেটা আমাদের উদ্দেশ্যও নয়।

নিচের রোগগুলো খাবার, খাদ্যের অভ্যাস এবং পরিপাক ক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত-

➽ বমি বমি ভাব ও বমি

খাদ্য ঠিকমতো পরিপাক বা হযম না হলে বমি বমি ভাব এবং অস্বস্তি হতে পারে। কখনো কখনো বমিও হয়, যা আমাদের সবারই কম বেশি অভিজ্ঞতা আছে।

➽ পুষ্টির অভাব

খাদ্য যদি সঠিকভাবে হজম না হয়, তবে ভাল খাবার খাওয়া সত্ত্বেও শরীর তা থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে না। এর ফলে দেখা দেয় পুষ্টির অভাব। এতে অপুষ্টি, দুর্বলতা, ক্লান্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

➽ পেটে অস্বস্তি ও পেট ব্যথা

পেটের সমস্যা থেকে পেট ব্যাথা- এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। পেটব্যাথা সচরাচর ভেজাল, গুরুপাক খাবার, ভাজাপোড়া, ডুবোতেলে ভাজা খাবার থেকে হয়। এছাড়া পেটের এসিড বা গ্যাস থেকেও পেট ব্যাথা হয়।

আবার দীর্ঘমেয়াদে আমাশয়, পিত্ততলিতে পাথর, এপেনডিসাইটিস ইত্যাদি থেকেও পেট ব্যাথা হয়।

➽ গ্যাস ও পেট ফাঁপা

: অপরিপক্ক খাদ্য অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে গাঁজন প্রক্রিয়ার শিকার হলে অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে, যা পেট ফাঁপার কারণ হয়।

পেট ফাঁপা অত্যন্ত অস্বস্তিকর, বিরক্তিকর ও কষ্টদায়ক।

➽ ডায়রিয়া

পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হলে ডায়রিয়া (পাতলা পায়খানা) দেখা দিতে পারে, যখন মল নরম হইয়া বার বার পায়খানা হয় এবং পায়খানার তরলতা বাড়িয়া যায়। পায়খানায় জলীয় অংশ বেশি থাকে, মলের পরিমাণ খুব কম থাকে। জীবনে ডায়রিয়া হয়নাই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

➽ বেসিলারি ডিসেন্ট্রি বা রক্ত আমাশয়

আমাশয় হয়ে থাকে অন্ত্রের প্রদাহের কারনে। এটি ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া বা পরজীবীর সংক্রমণের ফলে হতে পারে।

আমাশয়ের প্রধান লক্ষণ হলো পাতলা পায়খানা। যার সাথে রক্ত যেতে পারে এবং শ্লেষ্মা থাকতে পারে। অপরিষ্কার, দূষিত খাবার এবং অবিশুদ্ধ পানিই আমাশয়ের প্রধান কারন।

আর রক্ত আমাশয় হল- যে আমাশয়ে পায়খানার সাথে রক্ত ও শ্লেষ্মা (মিউকাস) মিশে বের হয়। এই অবস্থা অন্ত্রের মারাত্মক সংক্রমণকে নির্দেশ করে। একে ডিজেন্ট্রি (Dysentery)-ও বলা হয়।

➽ এ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি বা শাও আমাশয়

এ্যামিবা নামক এক প্রকার এককোষী প্রোটোজোয়া দ্বারা অন্ত্র সংক্রমিত হয়ে যে আমাশয় হয়, সেটাই এ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি। খাদ্য ও পানীয়ের সাথে মিশে এই জীবানু পেটে ঢুকে। এ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি হলে বার বার মলত্যাগ হয় ও তৎসঙ্গে মিউকাশ থাকে। কখনো কখনো কখনো, বিশেষত বর্ষাকালে এই রোগ মহামারি আকারে দেখা যায়।

➽ জিয়ারডিয়াল আমাশয় (Giardial Dycsentry)

‘জিয়ারডিয়াল ইনটেস্টাইনেলিস’ নামক এক প্রকার পরজীবীর সংক্রমনে এই ধরনের আমাশয় হয়। এই সংক্রমন ঘটে অন্ত্রের সিকাম ও কোলনে। সাধারনত জিয়ারডিয়াল ইনফেকশনে ছোট বাচ্চাদের পেটের গন্ডগোল বেশি দেখা দেয়। কাঁচা ফল, সব্জি, দুধ, পানি ইত্যাদির মাধ্যমে জীবানু পেটে গিয়ে এই রোগ সৃষ্টি হয়।

➽ ফুড পয়জনিং (Food Poisoning)

ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারনে পরিপাকজনিত অসুখ দেখা দেয়। ফুড পয়জনিং হতে পারে বাসী খাবার থেকে। এছাড়া খাবারের উপরে মাছি, টিকটিকি, তেলাপোকা, ইঁদুর ইত্যাদি বসিলে এবং সেই খাবার কেউ খেলে ফুড পয়জনিং এর শিকার হতে পারে।

পিতল বা কাঁসার পাত্রে খাদ্য রাখিলে সেই পাত্র থেকে ধাতু মিশে খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। এছাড়া রোগাক্রান্ত ব্যক্তি খাদ্য প্রস্তুত এবং পরিবেশন করিলেও ঐ ব্যক্তির জীবাণু মিশ্রিত হইয়া ফুড পয়জনিং হতে পারে।

➽ কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)

আমাদের খাওয়া খাদ্যের প্রয়োজনীয় অংশ বাদে অসার অংশ ১২ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাহির না হলে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। অন্ত্রের রোগ, অন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়াতে ব্যাঘ্যাত সৃষ্টি হওয়া, যকৃতের কার্যক্ষমতা হ্রাস, উপযুক্ত খাদ্যার অভাব প্রভৃতি কারনে কোষ্ঠকাঠিন্য বা কষা পায়খানা হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মল শক্ত হয়ে যায় এবং মলাশয় হতে মল সম্পূর্ণ নিঃসৃত হয়না বা হতে চায়না। কখনো কখনো পায়খানার সাথে রক্ত যেতেও দেখা যায়।

সাধারনত শাকসব্জি ও ফলমূল না খেলে, ভিটামিনের বা হরমোনের অভাব হলে, খাওয়ার পর পানি কম খেলে, সময়মত খাবার না খেলে, দীর্ঘদিনের ঘুমের ঘাটতি থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্য।

একেক জনের মলত্যাগের রুটিন একেক রকম হতে পারে। কারো যদি নিয়মিতভাবে ২/৩ দিন পর পর মলত্যাগ হয়, সেটা কোন সমস্যা নয় এবং সেটা কোষ্ঠকাঠিন্য ও নয়।

➽ জন্ডিস

আমাদের যকৃত বা কলিজার একটি সিরিয়াস রোগ হল জন্ডিস বা পান্ডুরোগ (Jaundice)। জন্ডিস হয় রক্রে বিলিরুবিন নামক হলুদ রঞ্জক পদার্থ বেড়ে গেলে। রক্তের লোহিত রক্তকণিকা (RBC) ভেঙে গেলে তৈরি হয় বিলিরুবিন। বিলিরুবিন হল পিত্তের অংশ, যা লিভারে তৈরি হয় এবং পিত্তথলিতে জমা হয়। বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.২ থেকে .০৮ মিলিগ্রাম। এ মাত্রে ২ মিলিগ্রামের উপরে উঠিলে চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়। ক্রমে জিহ্বার নিদের অংশও হলুদ হয় এবং সবশেষে শরীরের চামড়াও হলুদ বর্ণ ধারন করে।

কিন্তু প্রশ্ন হল- এসবের সাথে পরিপাক বা হযমের সম্পর্ক কি? কেন একে পরিপাকজনিত রোগ বলা হবে।

যকৃতে পিত্ত তৈরি হয়। এর কিছু অংশ পিত্তথলিতে জমা হয়। প্রানির কালচে নীল বর্নের পিত্তথলি আমরা সবাই চিনি। পরে এই পিত্ত পিত্তবাহী নলের ভিতর দিয়া ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনামে আসে। এই রস প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্যকে হযমে সহায়তা করে। এছাড়া কিছু গুরুপাক খাদ্য হযমেও কাজ করে।

কোন কারনে পিত্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে এই রস ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছাতে না পেরে ধীরে ধীরে রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়। শরীরের বর্ণও তখন হলুদ রং ধারন করে। এই অবস্থায় ডিওডেনামভুক্ত খাদ্যের সাথে পিত্ত মিশ্রিত না হবার ফলে চর্বি জাতীয় খাবার হযম হয়না। তখন পায়খানার রং স্বাভাবিক না হয়ে মেটে রং ধারন করে। এমনিভাবে নানা কারনে পিত্তরস রক্তের সাথে দেহে শোষিত হয়ে জন্ডিস রোগের সৃষ্টি করে।

➽ এপেন্ডিসাইটিস

ক্ষুদ্রান্ত্রের শেষ প্রান্তেই বৃহদান্ত্রের শুরু। ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রের মিলনস্থলে সিকামের মধ্যে একটি সরু নলের মত অংশ সংযুক্ত আছে, যার নাম অ্যাপেন্ডিক্স (Appendix)। কোন কারনে অ্যাপেন্ডিক্সে প্রদাহ দেখা দিলে তাকে এপেন্ডিসাইটিস (Appendicitis) বলে।

সাধারনত ৪ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত এই রোগ হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে Appendix ছোট হয়। এই রোগের কোন সুনির্দিষ্ট কারন নাই। অনিয়মিত আহার, কোষ্ঠ্যকাঠিণ্য এই রোগ জন্মাতে সাহায্য করে।

এই রোগ প্রকাশিত হলে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন করিয়া Appendix কেটে ফেলা। এতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। অ্যাপেন্ডিক্সে এর ফোঁড়া ফেটে গিয়ে শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

➽ বদহযম (Dyspepsia)

এটি একটি হযমের গোলমালজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। বদহযম শব্দটি মেডিক্যাল টার্ম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বদহযম হলে পেটের উপরিভাগে অস্বস্তি, ব্যথা বা জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়। বদহযম একটি দীর্ঘস্থায়ী বা নির্দিষ্ট রোগের লক্ষণ হিসাবে দেখা দিতে পারে।

গ্যাস্ট্রিক আলসার, এসিড রিফ্লাক্স (GERD), ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রভৃতি কারনে বদহযম হয়। এই রোগ হলে পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা জ্বালা, বুক জ্বালা (Heartburn), অতিরিক্ত ঢেকুর ওঠা, অল্প খেলেই পেট ভরা অনুভব হওয়া, বমি বমি ভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

➽ অজীর্ণ (Indigestion)

এটিও একটি হযমের গোলমালজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। তবে বদহযমের সাথে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এটি কোন মেডিক্যাল টার্ম নয়, সাধারণ ভাষার টার্ম। পরিপাকতন্ত্রে হযমের কাজ ঠিকমত না হলে অজীর্ণ রোগ হয়। এটি একটি অস্থায়ী ও সাধারন পেটের সমস্যা, যা খাবার বা অভ্যাসগত কারনে হয়। প্রায়শঃই ঘরোয়া চিকিৎসায় সেরে যায়।

অতিরিক্ত বা দ্রুত খাওয়া, তৈলাক্ত বা মশলাযুক্ত খাবার, মানসিক চাপ বা উদ্বেগ, ঘুমের অভাব ইত্যাদি কারনে অজীর্ণ রোগ হয়। এর ফলে খাবার খাওয়ার পর অস্বস্তি, পেট ফেঁপে থাকা, ভারি ভাব বা ঢেকুর ওঠা, হালকা পেট ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে।

➽ হাইপার এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস (Hyper Acid Gastritis)

আমরা জানি, পাকস্থলির একটি বড় কাজ হল- হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসরনের মাধ্যমে প্রধানত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য- ডিম-দুধ-মাংস ইত্যাদি হযমে সহায়তা করা। কোন কারনে যদি এই এসিড নিঃসরন প্রয়োজনের তুলনায় বেড়ে যায়, তবে এক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়, এটাই হাইপার এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস। জেনে রাখা ভাল ‘হাইপার’ কথাটি দ্বারা উচ্চ বা বেশি বুঝায় এবং ‘হাইপো’ কথাটি দ্বারা নিচু বা কম বুঝায়।

হাইপার এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস হলে ক্ষুধা লাগলে উপরের পেটে ও বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া ভাব থাকে। পেট শূন্য হলে ব্যাথা অনুভব হয়। কিছু খাবার পরে ব্যাথা সামান্য কমে। এই অবস্থায় বেশি ক্ষুধা হয় এবং দ্রুত হযম হয়। ধীরে ধীরে ব্যাথা বৃদ্ধি পায় এবং এটা পেপটিক আলসারে রূপ নেয়।

➽ হাইপো এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস (Hypo Acid Gastritis)

হাইপো এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস হল যখন পাকস্থলি থেকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রয়োজনের তুলনায় কম নিঃসরন হয়।

হাইপো এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস এ আক্রান্ত হলে রক্তশূন্যতা, ক্ষুদামন্দা, বুক জ্বালাপোড়া, অম্ল ঢেকুর, বমি বমি ভাব ও পাতলা পায়খানা হতে পারে।

➽ গ্যাস্ট্রাইটিস

গ্যাস্ট্রাইটিস (Gastritis) বা সাধারনের ভাষায় গ্যাস্ট্রিক হলো পাকস্থলীর ভেতরের আবরণের প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন। আমরা জানি, আমাদের পাকস্থলির ভিতরের দেয়াল তিন স্তরবিশিষ্ট। আর পাকস্থলি হাইড্রোক্লোরিক এসিড তৈরি করে খাদ্য হজমে সাহায্য করে এবং খাদ্যের সাথে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে। পাকস্থলীর ভেতরের আবরণ এই অ্যাসিড থেকে পাকস্থলীকে সুরক্ষা দেয়। যখন এই আবরণ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রদাহযুক্ত হয়, তখন তাকে গ্যাস্ট্রাইটিস বলে। গ্যাস্ট্রাইটিস হতে পারে তীব্র (অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রাইটিস) অথবা দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক গ্যাস্ট্রাইটিস)।

গ্যাস্ট্রাইটিস হতে পারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ব্যথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অটোইমিউন রোগ ইত্যাদি কারনে।

গ্যাস্ট্রাইটিস হলে পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি, বুক জ্বালা করা, বমি বমি ভাব, বমি (কখনও রক্ত সহ), পেট ফাঁপা, দ্রুত পেট ভরে যাওয়া, খাওয়ার পর পেট ভরা বোধ করা, ক্ষুধামান্দ্য, কালো রঙের মল (পেটে রক্তক্ষরণের কারণে) ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

➽ গ্যাস্ট্রিক আলসার (Gastric Ulcer)

আলসার (Ulcer) হল- সাধারনতঃ পাকস্থলি, অন্ত্র ও খাদ্যনালীর ক্ষত। বিভিন্ন কারনে পাকস্থলিতে, ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনাম ও খাদ্যনালিতে ক্ষত বা ঘা হতে পারে, এটাই আলসার। আলসার থেকে রক্তক্ষরন, এমনকি পাকস্থলি ও ডিওডেনামে ছিদ্র হওয়ার মত ঘটনাও ঘটতে পারে। এর থেকে পেটের ক্যান্সারও হতে পারে।

পাকস্থলিতে অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপাদন, মানসিক চাপ, ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান ইত্যাদি কারনে গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস এর অতিরিক্ত ব্যবহারের কারনে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়।

আলসারের কারনে পেটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বদহজম, পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব, বমি, কালো বা আলকাতরার মতো মল, দ্রুত পেট ভরে যাওয়া, অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

আলসার পাকস্থলিতে হলে তাকে গ্যাস্ট্রিক আলসার বলে। গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রাথমিক অবস্থায় এর লক্ষণ ধরা পড়েনা। পাকস্থলি থেকে রক্তক্ষরণ হলে বা পাকস্থলিতে ছিদ্র হলে এর লক্ষণ পুরোপুরি প্রকাশ পায়।

➽ ডিওডেনাল আলসার (Duonenal Ulcer)

আলসার যখন ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনামে হয়, তখন তাকে ডিওডেনাল আলসার বলে। ডিওডেনাল আলসারও ডিওডেনামের প্রাচীর ভেদ করে ছিদ্র তৈরি করতে পারে এবং এভাবে পেটের ভেতরের অংশ সংক্রমিত করতে পারে। এটি একটি জরুরি অবস্থা।

➽ পেপটিক আলসার (Peptic Ulcer)

গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ডিওডেনাল আলসার এর সাধারন নাম হল পেপটিক আলসার। অর্থাৎ সাধারনভাবে গ্যাস্ট্রিক আলসার নাকি ডিওডেনাল আলসার সেটা যখন সঠিকভাবে বুঝা যায়না, তখন সেটাকে পেপটিক আলসার হিসাবে ধরা হয়।

➽ আইবিএস (IBS)

অধিক রাত্র জাগরন, অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করিলে কিংবা অধিক মসলাযুক্ত গুরুপাক বা ভুনিয়া খাদ্য খেলে আইবিএস রোগ হয়। সাধারনতঃ যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, খিটখিটে মেজাজের তাদের আইবিএস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

আইবিএস হলে হযমের গুরুতর সমস্যা হয়, পায়খানার সাথে আম যায়, কোষ্ঠ্যকাঠিণ্য থাকে, বুক জ্বলে, বমি বমি ভাব বা অস্বস্থি থাকে, ঘি বা দুধ হযম করতে পারেনা।

➽ ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD)

আইবিডি হল এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ। এটি পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন সৃষ্টি করে। এর ফলে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, ওজন হ্রাস এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

➽ পাইল্‌স বা অর্শ (Piles)

পায়ুপথের ভিতরের ও বাইরের রক্তনালিগুলি ফুলে যাওয়া ও প্রদাহের সৃষ্টি হওয়া এবং শিরাতে মটর দানার মত বলি সৃষ্টি হওয়া, একেই বলে পাইলস বা অর্শ রোগ। অর্শ হলে পায়খানার সাথে রক্ত যায়। এই অর্শ বা বলি কারো ভিতরে আবার কারো বাহিরে থাকে। শক্ত পায়খানার সময় জোরে কোঁথ দিলে এই বলি বাইরে বেরিয়ে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পায়খানা শেষ হলে এই বলি আপনা আপনিই ভেতরে চলে যায়। যাদের কোষ্ঠ্যকাঠিন্য আছে, তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

পাইলস হলে পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল রক্ত যায়, মলদ্বারের বাইরে ফোলা মাংসপিণ্ডের মতো অনুভূত হয়। কখনো পায়ুপথে ব্যথা বা চুলকানি হয়, পায়খানার সময় পিচ্ছিল জাতীয় পদার্থ বের হয়।

পাইলস বিভিন্ন কারনে হতে পারে, যেমন- হেপাটাইটিস, যকৃতের গোলমাল, লিভাবের পুরাতন রোগ বা সিরোসিস। দীর্ঘদিনের কোষ্ঠ্যকাঠিন্য থাকলে, পায়খানার সাথে জোরে কোঁথ দিলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত আমাশয় রোগে ভোগা, মূত্রাশয়ের রোগ, রেনাল স্টোন, প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি, মহিলাদের পূর্ণ গর্ভাবস্থায় জরায়ুর উপর বেশি চাপ ইত্যাদি কারনেও পাইলস হতে পারে।

পাইলস এর জটিল উপসর্গ হল- অতিরিক্ত রক্তপাতে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা প্রকাশ পেতে পারে। মলদ্বারে ফোঁড়া ও Septic হতে পারে। অর্শ থেকে ভগন্দর হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

➽ পিত্তথলির প্রদাহ

পিত্তথলি (Gallbladder) যকৃতের নিচে অবস্থিত একটি ছোট অঙ্গ যা পিত্তরস জমা করে রাখে এবং পিত্তরস পরিপাক ক্রিয়ায় বা হযমে সহায়তা করে।

পিত্তথলির প্রদাহ (Cholecystitis) হল পিত্তথলির একটি রোগ যাতে পিত্তথলি প্রদাহে (Inflammation) আক্রান্ত হয়। পিত্তথলিতে পাথর, পিত্তথলিতে টিউমার, ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ইত্যাদি কারনে পিত্তথলির প্রদাহ হয়।

তীব্র পিত্তথলির প্রদাহ হঠাৎ শুরু হয় এবং প্রচন্ড ব্যাথা করে। দীর্ঘকালীন প্রদাহ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এবং বার বার হয়, যার ফলে পিত্তথলির দেয়াল পুরো হয়ে যেতে পারে।

➽ অগ্ন্যাশয় প্রদাহ

অগ্ন্যাশয় (Pancreas) পাকস্থলির পশ্চাতে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত একটি অঙ্গ। অগ্ন্যাশয় হতে অগ্ন্যাশয় রস নিঃসৃত হয় যা হযম ক্রিয়ায় সাহায্য করে। অগ্ন্যাশয় হতে একটি নল ও পিত্তথলির একটি নল একত্রে মিশে ডিওডেনামে প্রবেশ করেছে।

পাকস্থলি থেকে খাদ্য ডিওডেনামে প্রবেশ করিলে অগ্ন্যাশয়ের সাধারন গ্রন্থি থেকে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়ে ডিওডেনামে খাদ্যের সাথে মিশ্রিত হয়। কোন কারনে অগ্ন্যাশয় রসের সাহায্যে ভুক্ত খাদ্য হযমে অসুবিধা হলে অগ্ন্যাশয়ের টিস্যুগুলি অকেজো হয় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ দেখা দেয়।

অনিয়মিত খাদ্য গ্রহন, অধিক মদ্যপান এবং অধিক রাত্রি জাগরন করিলে অগ্ন্যাশয় প্রদাহ হয়। ৪০/৫০ বছরের বা অদুর্ধ লোকের মধ্যে এই রোগ হতে দেখা যায়।

অগ্ন্যাশয় প্রদাহ হলে তলপেটে খুব ব্যাথা হয়। ব্যাথা হলে Pulse rate খুব দ্রুত হয়, ব্লাড প্রেসার কমে যায়।

➽ পাকস্থলির ক্যান্সার

ক্যান্সার মানেই হল নিয়ম না মেনে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পাকস্থলীর ভেতরের স্তরে কোষের এরূপ অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিকেই পাকস্থলীর ক্যান্সার বলে। পাকস্থলীর ক্যান্সার কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে টিউমার গঠন করতে পারে। এই টিউমার ধীরে ধীরে পাকস্থলীর প্রাচীরের গভীরে প্রবেশ করে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পাকস্থলীর ক্যান্সারের সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি, তবে কিছু ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করা গেছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori) সংক্রমণ, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণাক্ত, ধোঁয়াযুক্ত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, বয়স (বৃদ্ধ বয়সে ঝুঁকি বাড়ে), অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ইত্যাদি।

➽ বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার

বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার কে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারও বলা হয়। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার হয় যখন বৃহদান্ত্র বা মলাশয়ের (রেকটাম) ভেতরের আবরণে ক্যান্সার কোষ সৃষ্টি হয় বা কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটে। এই কোষগুলো টিউমার গঠন করতে পারে এবং যথাযথ চিকিৎসা না হলে কোলন বা রেক্টামের প্রাচীরের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। সেখান থেকে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

➽ কোলন ক্যান্সার

কোলন বৃহদান্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা সিকামের পরে এবং মলাশয়ের আগে অবস্থিত। কোলন ক্যান্সার হলো বৃহদন্ত্রের কোলন অংশে কোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এটি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারেরই একটি অংশ। সহজ করে বললে, যখন কোলনের ভেতরের দেয়ালে কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হতে শুরু করে এবং টিউমার গঠন করে, তখন তাকে কোলন ক্যান্সার বলা হয়।

➽ হার্নিয়া (Hernia)

পেটের নাড়ীভুড়ির একটি অংশ পেরিটোনিয়াম সহ কুচকির ছিদ্রপথ দিয়ে বাহির হয়ে এসে চামড়ার নিচে অবস্থানের নাম হার্নিয়া। কিছু ক্ষেত্রে হার্নিয়া অন্ডকোষের অন্ড পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সেটা চলাফেরা বা বসার সময় নেমে যায়, চিৎ হয়ে শুইলে পেটের মধ্যে ঢুকে যায়। কখনো কখনো সেটা পেটের ভিতর পুনরায় যেতে না পারার কারনে হার্নিয়ার স্থানটি ফুলে উঠে।

আঘাত লাগা, ভারী জিনিস উঠানো, জোরে হাঁচি-কাশি, জোরে চিৎকার ইত্যাদি থেকে হার্নিয়া হতে পারে।

➽ দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা

ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার সঠিকভাবে হজম না হলে পায়খানা তৈলাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে।

➽ ওজন হ্রাস

হযমের জটিলতা থাকলে সঠিক এবং পুষ্টিকর খাবার খেলেও সঠিকভাবে পরিপাক হয়না। ফলে দেহ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত্ত হয়। এর ফলে ঘটে ওজন কমে যাওয়ার ঘটনা।

➽ অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা (Anemia)

দীর্ঘমেয়াদি পরিপাকজনিত সমস্যায় হতে পারে আয়রন ও ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি। এর ফলে দেখা দিতে পারে অ্যানিমিয়া রক্তশূণ্যতা।

➽ হাড়ের দুর্বলতা

দীর্ঘমেয়াদি পরিপাকজনিত সমস্যায় সৃষ্টি হতে পারে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি এর অভাব। ফলে দেখা দিতে হাড়ের দুর্বলতা রোগ।

➽ ত্বকের সমস্যা

আমাদের পরিপাক ক্রিয়ার সাথে ত্বকের সমস্যারও বেশ জটিল সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের অন্ত্রে বাস করে কোটি কোটি জীবাণু, যার মধ্যে আছে উপকারী ব্যাক্টেরিয়া, যারা একটি ভারসাম্য বজায় রেখে আবস্থান করে। এরা যে শুধু আমাদের হযমে সাহায্য করে শুধু তাই নয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রনে ও ভুমিকা রাখে। কোন কারনে এদের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে (চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে বলে ডাইসবায়োসিস) এর প্রভাব ত্বকের উপরও পড়ে।

এই প্রভাবটা পড়ে অন্ত্র থেকে ত্বকে প্রদাহ (Inflammation) স্থানান্তরের মাধ্যমে, অন্ত্রের ভেদ্যতা বৃদ্ধি করে প্রথমে রক্তপ্রবাদে এবং পরে ত্বকে জীবাণু প্রবেশ করার মাধ্যমে এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা আকারে।

ত্বকের যে যে সমস্যা পরিপাকতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো হল- ব্রণ (Acne), একজিমা (Eczema) বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস, রোজাসিয়া (Rosacea), সোরিয়াসিস Soriasis) ইত্যাদি।

➽ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

আমাদের পরিপাক বা হযম প্রক্রিয়ার সাথে ব্রেইনের তথা মানসিক স্বাস্থ্যের একটি অত্যন্ত নিবিড়, শক্তিশালী এবং জটিল সম্পর্ক রয়েছে। একে বলা হয় “অন্ত্র-মস্তিষ্ক অক্ষ” (Gut-Brain Axis) বলা হয়।

আমরা জানি, আমাদের অন্ত্রে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি জীবাণু বাস করে, যার মধ্যে কিছু আছে ক্ষতিকর এবং কিছু উপকারী। এরা একটা ভারসাম্য বজায় রেখে অবস্থান করে। এরা হযম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করার পাশাপাশি ব্রেইনের বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার (যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন, GABA) উৎপাদনেও ভূমিকা রাখে। ব্রেইনে উৎপাদিত বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার বিভিন্নভাবে আমাদের মেজাজ, আবেগ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বলা হয়ে থাকে যে, আমাদের পেটের ভিতরেও একটা ব্রেইন আছে। ব্রেইন থেকে পেটের কাছে নির্দেশ যায় ২০%, আর পেট থেকে ব্রেইনের কাছে নির্দেশ যায় ৮০%। অন্ত্র এবং মস্তিষ্কের মধ্যে এই যোগাযোগ ঘটে ভেগাস স্নায়ুর (Vagus Nerve) মাধ্যমে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, পেটে বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য ব্রেইন তথা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলে।

➽ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস

পরিপাক বা হযম প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ- আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো- হাত, পা, হাড়, পেশি, মস্তিষ্ক, চোখ, লিভার, কিডনি ইত্যাদি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি উপাদান খাদ্য থেকেই পেয়ে থাকে। যথাযথ পরিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা শোষিত হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। যখন পরিপাক ক্রিয়ায় গোলমাল দেখা দেয়, তখন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে তাদের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।

যেমন- আয়রনের অভাবে রক্তাল্পতা সৃষ্টি হয়, শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়, ভিটামিন বি১২ এর অভাব স্নায়ুর ক্ষতি হয়- যার ফলে হাত-পায়ে অসাড়তা, দুর্বলতা দেখা দিয়ে হাঁটাচলায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।ীএছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় দুর্বল (অস্টিওপরোসিস) এবং পেশী দুর্বলতার কারণ হতে পারে, ভিটামিন ডি এর অভাব হাড় দুর্বল করে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। প্রোটিনের অভাবে পেশিতে দুর্বলতা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ার কারন হতে পারে।

➽ জল উদরী (Ascites)

পেটের মধ্যে পানি জমলে তাকে জল উদরী বলে। পাকস্থলির বহির্ভাগ পেরিটোনিয়াম নামক ঝিল্লি দ্বারা ঢাকা। পেটের নাড়িভুড়ি, যকৃত, প্লীহা ও চামড়ার নিচে কমবেশি ফাঁকা বা খালি জায়গা থাকে। ঐ স্থানে (পেরিটোনিয়াম কেভিটিতে) রক্তের জলীয় অংশ জমা হইয়া জল উদরী রোগের সৃষ্টি করে।

পানি জমার কয়েকটি কারণ হল- কিডনীর প্রদাহ, ম্যালেরিয়া, পুরনো বদহযম, রক্তশূন্যতার কারনে হার্টের দুর্বলতা, জননযন্ত্রের অসুখ ইত্যাদি।

➽ পাকস্থলির শীর্ণতা (Gastric Atrophy)

পাকস্থলির শীর্ণতা এমন একটি অবস্থা যখন পাকস্থলীর ভেতরের আবরণ ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে যায় এবং এনজাইম নিঃসরণকারী গ্রন্থিগুলো সংখ্যায় কমে যায় বা তাদের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।

দীর্ঘদিন ধরে ডিসপেপসিয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, অজীর্ন, পাচকরসের অভাব ইত্যাদি কারনে এই রোগ হয়। এছাড়া পাকস্থলির প্রদাহ, পুরাতন ক্ষত, পেপটিক/গ্যাস্ট্রিক আলসার, পুরাতন আমাশয় ইত্যাদি কারনেও এই রোগ হতে পারে।

➽ পাকস্থলির শেষ প্রান্ত সরু হয়ে যাওয়া (Pyloric Stenosis)

পাইলোরিক স্টেনোসিস অর্থাৎ পাকস্থলির শেষ প্রান্ত সরু হয়ে যাওয়া পেপটিক আলসার রোগের একটি উপসর্গ।

পাকস্থলির উপর ও নিচ প্রান্ত স্বাভাবিকভাবেই সরু। ভুক্ত খাদ্যদ্রব্য এই পথেই পাকস্থলি হতে ক্ষুদ্রান্ত্রে যায়। পাকস্থলির নিচ প্রান্তে এবং ডিওডেনামে ঘা হলে, যদি এর সুচিকিৎসা না হয়, তবে ঘা বৃদ্ধি পায় ও আবার শুকিয়ে যায়। এমনিভাবে বার বার ঘা বৃদ্ধি পাওয়া ও শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ঐ স্থান কোঁচকে যায় ও পূর্বের চেয়ে বেশি সরু হয়। ফলে ভুক্ত খদ্যদ্রব্যের সম্পূর্ণ অংশ ক্ষুদ্রেন্ত্রে না যেতে পারলেও কিছু অংশ যেতে পারে। এটাই হল- পাকস্থলির শেষ প্রান্ত আংশিক সরু হয়ে যাওয়া।

এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এমনকি তরল খাদ্যদ্রব্যও ক্ষুদ্রেন্ত্রে যেতে পারেনা। একে বলে কমপ্লিট পাইলোরিক স্টেনোসিস।

➽ নাড়ীভুঁড়ির একাংশ অন্য অংশের মধ্যে ঢুকে পড়া

সাধারনতঃ ছোট ছেলেমেয়েদের এই রোগ হয়ে থাকে। অন্ত্রের এক অংশ অন্য অংশের মধ্যে ঢুকে গেলে, কোন খাদ্যই আর একস্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারেনা। এটা এক ধরেনের ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন।

এই অবস্থায় মুখে খাবার দেওয়া সম্পূর্ন বন্ধ করতে হয় এবং জরুরী অপারেশনের প্রয়োজন পরে।

➽ অন্ত্রে প্যাচ লাগা

এই রোগে ক্ষুদ্রান্ত্রের এক অংশ অন্য অংশের সাথে জড়িয়ে যায়। এবং ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের পথে কোন খাদ্যই আর এক স্থান হতে অন্য স্থানে নড়াচড়া করতে পারেনা। এটাও এক ধরনের ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন।

➽ পেটের জরুরী বা সংকটাপন্ন অবস্থা (Acute Abdomen)

পেটের যে কোন সংকটপূর্ণ অবস্থার নাম একিউট এ্যাবডোমেন। বিভিন্ন কারনে পেটে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারন হল- বিষপান, পিত্তকোষের মারত্মক অসুবিধা, এপিনডিসাইটিস হইলে, ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন হলে, হার্নিয়া আটকে গেলে, পেরিটোনিয়ামের মারাত্মক প্রদাহের জন্য, অগ্ন্যাশয়ের কঠিন প্রদাহের জন্য ইত্যাদি।

➽ এ্যাকিউট ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন

এটা হল ইনটেস্টাইন বা অন্ত্র অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রে কোন কিছু আটকে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে যাওয়া। বিভিন্ন কারনে ইনটেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন হতে পারে। সুস্থ শরীরে ক্ষুদ্রান্ত্র সকল সময় নড়াচড়া করে। স্টেথেস্কোপ দ্বারা পেট পরীক্ষা করলে বুটবাট শব্দ শোনা যায়। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হলে পেটে শব্দ কম শোনা যায়। কেঁচো কৃমিজনিত কারনে বা শক্ত পায়খানার জন্য এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পিত্তকোষের পাথর ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছালে এবং হার্নিয়ার জন্যও এই রোগ হতে পারে।

➽ গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD)

GERD হল এমন এক অবস্থা যখন পাকস্থলির এসিড (হাইড্রোক্লোরিক) খাদ্যনালিতে উঠে আসে, যার ফলে বুকে জ্বালা অনুভূত হয়, বুকে ব্যাথা করে, খাবার মুখে ফিরে আসে, খাবার গিলতে সমস্যা হয় ইত্যাদি।

এটা হতে পারে- নির্দিষ্ট কিছু খাবারের জন্য, যেমন- মশলাদার, টক, চর্বিযুক্ত খাবার। এছাড়া ধুমপান, স্থূলতা ইত্যাদি কারনেও GERD হতে পারে।

শেষকথা

উপরে উপরে উল্লেখিত রোগগুলি প্রত্যক্ষভাবে পরিপাকের সাথে জড়িত।

এছাড়াও আরো অনেক রোগ আছে যেগুলো পরোক্ষভাবে পরিপাকের সাথে জড়িত, বিশেষ করে লাইফস্টাইলজনিত রোগগুলো, যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালির ব্লক, হার্টের দুর্বলতা, হার্ট ব্লক, ব্রেইন প্রবলেম, লিভাবের বিভিন্ন সমস্যা, কিডনি রোগ, স্থূলতা ইত্যাদি।

সুতরাং একটু ভেবে দেখুন, খাবারের সাথে এবং খাদ্য পরিপাকের সাথে বেশিরভাগ মরনঘাতি রোগই জড়িত। তাই বাঁচতে হলে খাদ্যের বিষয়টাকে প্রতিদিনের সচেতনতায় তুলে আনতে হবে, বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে হবে খাদ্য নির্বাচন ও খাওয়ার ক্ষেত্রে। দৈনিক লাইফস্টাইলে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে নিজের জন্য পারফেক্ট খাদ্য তালিকা। মনে রাখবেন, খাদ্য যেমন আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তেমনি পারে মারতে।

পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
কমেন্ট করুন প্লিজ, আপনার কমেন্ট এপ্রিশিয়েট করা হবে।

মন্তব্য করুন