পরিপাক ও হযম (Digestion) এর মধ্যে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যদিও সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, আমরা এই পার্থক্য কে এড়িয়ে যাব। আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য এই পার্থক্যকে হিসাবে না নিলেও তেমন সমস্যা হবেনা।
খাদ্য পরিপাক বা হযম এর প্রসঙ্গ আসলে আমরা শুধুই এইটুকুই বুঝি যে- আমাদের খাদ্য হযম হচ্ছে কি হচ্ছে না। এর বাইরে আর কিছু ভাবিনা এবং ভাবার প্রয়োজনও পড়েনা।

কিন্তু প্রিয় পাঠক, এই জটিলতার যুগে, প্রসেস্ড্ ফুড ও দূষিত-বিষাক্ত-ভেজাল খাবারের যুগে স্বাস্থ্য বাঁচাতে আপনাকে পরিপাক সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে হবে। কারন আপনার দেহের প্রায় ৮৫% রোগ হয় পেট থেকে। অর্থাৎ ৮৫% রোগ আপনার খাদ্যের মান, পাকস্থলির স্বাস্থ্য ও হযম প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোন নলেজ যদি অর্জন করতে চান, তাহলে সবার আগে এই পরিপাক বা হযম প্রক্রিয়ার মেডিক্যাল বাস্তবতা সম্পর্কে জানুন।
আপনাকে জানতে হবে- খাদ্য পরিপাকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কি কি ধাপ পেরিয়ে যায়, কোন খাদ্য কিভাবে পরিপাক হয়, হযম হওয়ার পরে কোন খাদ্য কিভাবে দেহে কাজে লাগে, পরিপাক ঠিকমত না হলে কি সমস্যা হতে পারে- এর মধ্যে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা কি হতে পারে, খাদ্য হযমের যত্ন তথা পরিপাকতন্ত্র ভাল রাখার চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করবেন ইত্যাদি।
এই পোস্টে আমরা আপনাকে সহজ ভাষায় আপনার বোধগম্য ভাষায় এই বিষয়গুলোই উপস্থাপন করব, ইনশাল্লাহ।
প্রথমেই আমরা জেনে নেব, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিপাক বা হযম কি।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিপাক বা হযম
পরিপাক বা হযম বলতে আমরা সাধারনভাবে এটাই বুঝি যে, খাদ্য খাওয়ার পরে পেটে ব্যাথা হয় নাই, গ্যাস হয়্ নাই, পেট জ্বলে নাই, ভুটভাট করে নাই বা পায়খানায় সমস্যা হয় নাই। এসব কিছুই ঠিক আছে, কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিপাক বিষয়টা একটু ভিন্ন রকমের।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিপাক হল একটি প্রক্রিয়া যেখানে আমাদের খাওয়া খাবারগুলো ভেঙ্গে এমন কনায় রূপান্তরিত করে ফেলা যাতে শরীর সেটাকে শোষণ করে নিতে পারে।
আর একটু স্পষ্ট করে বললে, পরিপাক হল একটি শারীরিক বা যান্ত্রিক ও একই সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ আমাদের খাওয়া জটিল খাদ্য-শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাট কে ছোট, সরল ও দ্রবনীয় অণুতে রূপান্তরিত করে ফেলে যাতে দেহ সেগুলোকে রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে শোষন করে নিয়ে দেহের কাজে লাগাতে পারে।।
এই পর্যন্ত এসে আপনাদের আপনাদের মনে যে প্রশ্নগুলো আসতে পারে সেগুলো ক্লিয়ার করে দিচ্ছি-
প্রশ্নঃ শুধু কি শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাটই পরিপাক হয়? অন্য তিনটি খাদ্য উপাদান ভিটামিন, লবণ আর পানির কি পরিপাকের প্রয়োজন নেই?
উত্তরঃ না, ভিটামিন, লবণ আর পানি পরিপাক ছাড়াই আমাদের দেহে শোষিত হয়ে যায়।
প্রশ্নঃ খাদ্যের সারকণা রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত বা শোষিত হয় বুঝলাম, কিন্তু লসিকা মানে কি?
উত্তরঃ আমাদের দেহের খাদ্য নির্যাস, পানি, লবন, অক্সিজেন ইত্যাদি পরিবহনের জন্য রক্ত ছাড়াও আরো এক ধরনের পরিবাহক আছে, যা রক্তরস থেকে সৃষ্টি হয়, এগুলো হল লসিকা বা লিম্ফ (Lymph)।
প্রশ্নঃ হযমের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া কি?
উত্তরঃ যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হল- খাবার দাঁত দিয়ে কেটে পেষন বা চূর্ন করা, জিহ্বা দিয়ে নড়াচড়া করা, খাদ্যনালীর সংকোচন প্রসারন ইত্যাদি। আর রাসায়নিক প্রক্রিয়া হল-পাকস্থলির দেয়াল থেকে নিঃসৃত এনজাইমের সাহায্যে খাদ্যকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শোষনযোগ্য পদার্থে রূপান্তরিত করা।
এবার চলুন আমরা একনজরে দেখে নিই- মুখ থেকে শুরু করে পায়ু পর্যন্ত বা পায়খানা হওয়া পর্যন্ত আমাদের খাওয়া খাদ্য কিভাবে এগিয়ে চলে আর কি কি ঘটনা ঘটে।
আমাদের দেহের বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য আছে বিভিন্ন তন্ত্র বা সিস্টেম (System)। যেমন- রক্তের সমস্ত কাজকর্ম চলে রক্ত সংবহনতন্ত্র (Blood Circulatory System) এর মাধ্যেমে, দেহের স্নায়বিক কাজকর্ম চলে স্নায়ুতন্ত্র বা Nervous System এর মাধ্যমে। আরো আছে- শ্বসনতন্ত্র (Respiratory System), প্রজনন তন্ত্র (Reproductive System), রোগ প্রতিরোধ তন্ত্র (Immune System) ইত্যাদি। তেমনি আমাদের খাদ্য হযম ও পরিপাক যে তন্ত্রের মাধ্যমে হয়, সেটা হল পাচনতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র (Digestive System)।
অন্যান্য তন্ত্র সম্পর্কে কিছু ধারনা না থাকলে আমাদের সকলেরই পরিপাকতন্ত্র সম্পর্কে ধারনা আছে। অর্থাৎ মুখ থেকে শুরু করে খাদ্য খাদ্যনালী বেয়ে পেটে বা পাকস্থলিতে যায়, সেখান থেকে ক্ষুদ্রান্ত্র (চিকন নল), তারপর বৃহদন্ত্র (বড় নল) বেয়ে বেয়ে পায়ুপথ বা পায়খানার রাস্তা পার হয়ে খাদ্য পায়খানা হয়ে বের হয়। এই বিষয়টা আমরা সকলেই জানি।
কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে জেনে নেওয়া জরুরী।এছাড়া কিছু কিছু ডাক্তারী ভাষা আছে যা স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ শুনতে গেলে প্রায়শঃই আমাদের শুনতে হয়- যা প্রত্যেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের শিখে রাখা প্রয়োজন।
চলুন আমরা পুরো পরিপাকতন্ত্র কিভাবে কাজ করে- এই বিষয়টার উপর একটা অভিযান চালাই।
আমাদের পরিপাকতন্ত্র (Digestive System)
মুখ থেকে শুরু করে আমাদের পরিপাকতন্ত্র যে যে অংশ নিয়ে গঠিত তা ধারাবাহিকভাবে দেখে নিই-
⬒ মুখের ফাঁকাস্থান (Oral cavity): পরিপাক ক্রিয়ায় এর সাথে জড়িত- দাঁত, লালা, জিহ্বা
⬒ গলবিল (Pharynx)
⬒ খাদ্যনালী (Esophagus)
⬒ পাকস্থলি (Stomach)
⬒ ক্ষুদ্রান্ত্র (Small Intestine): এর তিনটি অংশ- ডিওডেনাম, জেজুনাম, ইলিয়াম
⬒ বৃহদান্ত্র (Large Intestine) এর অংশগুলো হল- সিকাম, কোলন, মলাশয় এবং মলদ্বার
চলুন কোথায় কি ঘটে সংক্ষাপে বুঝার চেষ্টা করি।
মুখের ফাঁকাস্থান (Oral cavity)
মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর থেকেই পরিপাকের কাজ শুরু। দাঁত খাবারকে কেটে, ছিড়ে এবং পিষে যথাসম্ভব ছোট করে। জিহ্বা নাড়িয়ে খাদ্যকে মুখের লালার সাথে মিশিয়ে পিচ্ছিল করতে এবং খাবারকে পরবর্তি ধাপে ঠেলে দিতে সাহায্য করে
মুখের কাজ শুধু খাদ্যকে ছোট কনায় পরিণত করাই হয়। প্রকৃতপক্ষে খাদ্য হযমের কাজ বেসিক্যালি এখান থেকেই শুরু হয়। লালা শুধু খাবারকে পিচ্ছিলই করেনা, লালার সাথে থাকে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম (Enzyme); যেমন-অ্যামাইলেজ, লাইপেজ, মিউকাস ইত্যাদি। এনজাইম খাদ্যকে পরিপাকে সাহায্য করে এবং একই সাথে খাদ্যের সাথে থাকা জীবাণুও ধবংস করে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন- খাদ্য ভাল করে চিবিয়ে খেতে হবে। আর তবেই খাদ্য হযম বা পরিপাকের কাজে আপনি এগিয়ে থাকলেন। খাদ্য ভালভাবে না চিবালে পরিপাক প্রক্রিয়ার কার্যক্রমে আপনি শুরুতেই হেরে গেলেন।
গলবিল (Pharynx)
গলবিল হলো মুখ ও নাকের পিছনের অংশ অর্থাৎ যেখানে গিয়ে আমাদের খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী একত্রিত হয়েছে, ঠিক দুই নদীর মোহনার মত। অর্থাৎ আমরা যাকে কন্ঠ বা গলা বলে চিনি-সেটাই গলবিল। আমরা অনেক সময় বলি- খাবার গলায় আটকে আছে বা গলায় কাটা বিঁধেছে- সেটা ঐ গলবিলে।
গলবিল এর কাজ কি? গলবিলের কাজ হল খাদ্য গেলার সময় যাতে খাদ্য শ্বাসনালীতে ঢুকে না যায়, সেজন্য একটি ঢাকনার মত অংশ এসে শ্বাসনালীর মুখ বন্ধ করে দেয়। এই বিশেষ ঢাকনার নাম এপিগ্লটিস (Epiglottis)। গলবিল এই যান্ত্রিক কাজটুকুই করে, সরাসরি হযমে ভূমিকা রাখেনা।
খাদ্যনালী (Esophagus)
গলবিল পার হয়ে এরপর খাদ্য লম্বা অন্ননালীতে (গলা থেকে পেট পর্যন্ত) ঢুকে। খাদ্য গেলার পর পাকস্থলিতে পৌঁছানো আপনার প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করেনা। অন্ননালী একটি বিশেষ পদ্ধতিতে খাবারকে পাকস্থলিত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এই পদ্ধতির নাম পেরিস্টালসিস।
পেরিস্টালসিস পদ্ধতিটি হল- খাদ্যনালির পেশি ঢেউয়ের মত ক্রমাগত সংকোচন প্রসারনের মাধ্যমে খাদ্যকে ঠেলে পাকস্থলিতে নিয়ে ফেলে। খাদ্যনালির দৈর্ঘ্য মোটামুটি ১০ ইঞ্চি।
পাকস্থলি (Stomach)
পাকস্থলি যাকে আমরা পেট বলি-এটা হল একটা থলে যাতে গিয়ে খাদ্য প্রাথমিকভাবে জমা হয়। জেনে রাখা ভাল- পাকস্থলিতেই কিন্তু সম্পূর্ণ হজম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়না, এখানে হযমের প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে হযম পরিপাক ক্রিয়ার মূল ঘটে প্রধানত ক্ষুদ্রান্ত্রে- তারপর বৃহদান্ত্রে।
দেখলেন তো আমরা কিন্তু সাধারন বুদ্ধি থেকে ধরে নিই যে, আমাদের হযমের কাজটা সম্পূর্ণভাবে পাকস্থলিতেই হয়। তাহলে প্রশ্ন হল- পাকস্থলিতে হযমের কতটুকু হয় বা কোন কাজগুলো হয়?
পাকস্থলি মূলত খাবার জমা রাখে, পাচকরসের সাথে মিশায় এবং হযমের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
আমরা জানি তিন ধরনের খাদ্য উপাদানই হযম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে- শর্করা, প্রোটিন এবং চর্বি। পাকস্থলিতে শুধু প্রোটিন অণু ভেঙ্গে সরল অণুতে রূপান্তরিত হয়। এখানে প্রধানত এসিডের রাজত্ব। পাকস্থলির দেয়াল থেকে নিঃসৃত হাইড্রোক্লোরিক এসিড হযমের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
পাকস্থলির গাত্র বা গা বা দেয়াল তিন স্তরবিশিষ্ট। পাকস্থলি গাত্রের বিভিন্ন স্তর থেকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCL) এবং কিছু এনজাইম, যেমন-পেপসিনোজেন, মিউকাস ইত্যাদি নিঃসৃত হয়ে পরিপাক ক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে। হাইড্রোক্লোরিক এসিড সহ নিঃসৃত এনজাইমগুলোকে একত্রে পাকরস বা Gastric juice বলে।
পাকস্থলির প্রধান কাজ হল- প্রোটিন অনুকে ভেঙ্গে এমাইনো এসিডে রূপান্তর করা এবং খাদ্যের মধ্যে থাকা জীবানুকে ধ্বংস করা।
কাজ শেষে পাকস্থলীর শক্তিশালী পেশীগুলো সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য এবং পাকরসকে ভালোভাবে মিশিয়ে একটি অর্ধ-তরল মিশ্রণ তৈরি করে, যাকে বলে কাইম (Chyme)। এবং একে ক্ষুদ্রান্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়।
কখনো কখনো কিছু খাবার খেলে পেট জ্বলে বা গলা জ্বলে। এটা হয় পাকস্থলির দেয়াল থেকে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসৃত হওয়ার ফলে এবং এসিড ঘটনাক্রমে পেট থেকে অন্ননালী বেয়ে গলার দিকে উঠে গেলে।
খাওয়ার পর সাথে সাথে বেশি পানি খাওয়া বারন। কারন বেশি পানি খেলে হাইড্রোক্লোরিক এসিড হালকা হয়ে ভালভাবে কাজ করতে পারেনা, ফলে হযমে গোলমাল হয়।
একটি ফ্যাক্ট জেনে রাখা ভাল- এসিডের স্বাদ টক হয় বলে বমির স্বাদ টক হয়, কারন বমির সাথে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও বের হয়ে আসে।
একটি প্রশ্ন জাগতে পারে হাইড্রোক্লোরিক এসিড তো একটি এসিড যা লোহাকে পর্যন্ত ক্ষয় করে দিতে পারে, তাহলে তা পেটে থাকে কিভাবে?
হ্যাঁ, এটা সত্যি, এটা সেই হাইড্রোক্লোরিক এসিডই যা ধাতুকে ক্ষয় করে দিতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, হাইড্রোক্লোরিক এসিড এর ক্ষয়কারী ভূমিকা এর ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। পেটে যে হাইড্রোক্লোরিক এসিড আছে, তা নিশ্চয় পেটে ভিতরে কাজ করার উপযোগি। তারপরও হাইড্রোক্লোরিক এসিড কখনো বেশি নিঃসৃত হলে পেট জ্বলে, বুক জ্বলে। এটা এসিডেরই প্রতিক্রিয়া।
ক্ষুদ্রান্ত্র (Small Intestine)
ক্ষুদ্রান্ত্রের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ থেকে ২৩ ফুটের মত, যাকে আমরা চিকন নল হিসাবে চিনি। গরুর ভূড়ি আলাদা করার পর আমরা সহজেই চিকন নল (ক্ষুদ্রান্ত্র) আর মোটা নল (বৃহদান্ত্র) চিনে ও বুঝে নিতে পারি।
ক্ষুদ্রান্ত্র বা Small Intestine ই হল পুষ্টির মূল শোষণ কেন্দ্র। এটি পরিপাকতন্ত্রের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ।
এর তিনটি অংশ- ডিওডেনাম, জেজুনাম, ইলিয়াম
ডিওডেনাম ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ এবং পাকস্থলী থেকে আসা কাইম এখানে প্রবেশ করে। এর সাথে যোগ হয় যকৃৎ থেকে আসা পিত্তরস এবং অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত অগ্ন্যাশয় রস।
জেজুনাম ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যবর্তী অংশ। এখানেই প্রধানত খাদ্যের পরিপাক এবং শোষণ সম্পন্ন হয়।
ইলিয়াম ক্ষুদ্রান্ত্রের শেষ অংশ যা বৃহদান্ত্রের সাথে যুক্ত। এখানে ভিটামিন বি১২ এবং পিত্ত লবণ শোষিত হয়।
মনে রাখতে হবে যে, ক্ষুদ্রান্ত্রের ভেতরের প্রাচীরে ভিলাস ও মাইক্রোভিলাস নামে অসংখ্য ভাঁজ থাকে। এই ভাঁজগুলো ক্ষুদ্রান্ত্রের শোষণকারী পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে খাদ্য থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণকে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে।
ভিলাসের মধ্যে রক্তনালী এবং ল্যাকটিয়েল থাকে যার মাধ্যমে শোষিত পুষ্টি উপাদান রক্ত এবং লসিকায় প্রবেশ করে।
বৃহদান্ত্র (Large Intestine)
বৃহদান্ত্রের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ ফুট। অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্ত্রের তুলনায় অনেক ছোট ও চওড়া।
এর প্রধান অংশগুলো হল- সিকাম, কোলন, মলাশয় এবং মলদ্বার।
বৃহদান্ত্র বা Large Intestine এর প্রধান কাজ হল- পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট অর্থাৎ বিভিন্ন লবণ শোষণ এবং বর্জ্য নিষ্কাশন।
এছাড়া বৃহদান্ত্রে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাস করে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অপাচ্য শর্করা ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করে যা কোলনের কোষগুলো ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া বৃহদান্ত্র যা করে তা হল- ভিটামিন কে ও কিছু বি ভিটামিন সংশ্লেষে সাহায্য করা।
খাদ্য হযমের কাজটা অর্থাৎ খাদ্যকে পায়খানা বানিয়ে ফেলার কাজটা রাসায়নিকভাবে করে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl), বিভিন্ন প্রকার এনজাইম, যেমন- পেপসিনোজেন, মিউকাস ইত্যাদি। এছাড়া ও অন্ত্রের দেয়াল থেকে নিঃসৃত কিছু হরমোন ও পরিপাকে ভূমিকা রাখে, যেমন- গ্যাস্ট্রিন, সিক্রেটিন, কোলেসিস্টোকিনিন ইত্যাদি।
➤ মল তৈরি ও নিষ্কাশন
বৃহদান্ত্রে অপাচ্য খাদ্য উপাদান জমা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এখানে মল তৈরি হয়। পেরিস্টালসিস এবং অন্যান্য পেশী সংকোচনের মাধ্যমে মল মলাশয়ে পৌঁছায় এবং অবশেষে মলদ্বার বা পায়ুর মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- পরিপাক প্রক্রিয়ায় আমাদের কোন খাদ্য উপাদান শোষিত হওয়ার জন্য কিসে পরিণত হয়?
উত্তর হল- শর্করা ভেঙ্গে গ্লুকোজ, প্রোটিন ভেঙে অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ফ্যাট ভেঙ্গে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিনত হয়।
সাধারনভাবে পানি, ভিটামিন ও খনিজের পরিপাকের প্রয়োজন নেই, এগুলো সরাসরি শোষিত হয়।
আমরা এতক্ষন আমাদের দেহের পরিপাক বা হযম প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারনা নিলাম। এখন এই সংশ্লিষ্ট যে কোন আলোচনা বুঝতে সহজ হবে।
এখন আমাদের একটি কমন প্রশ্নের সমাধান করার সময় এসেছে পরিপাক ক্রিয়ার গোলমালের কারনে বা খাদ্য ঠিকমত পরিপাক না হওয়ার কারনে কি কি শারীরিক সমস্য, রোগ ও জটিলতা দেখা দেয়৷
এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এর উত্তর জানাটা আমাদের প্রাত্যহিক সুস্থ জীবনযাপনের জন্যই প্রয়োজন।
মেডিক্যাল সায়েন্সে বলে যে, আমাদের ৮৫% রোগ হয় পেট থেকে-প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। এর কিছু পরিপাক প্রক্রিয়ার বিঘ্নতার কারনে এবং কিছু হয় নষ্ট খাদ্য গ্রহন ও খাবার দাবারে অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের কারনে।
এই পরিসরে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, স্বাভাবিক পরিপাক বা হযম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলে নিম্নরূপ স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়-
- ☘দুর্বলতা, ক্লান্তি, রোগ
- ☘প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
- ☘পাকস্থলির প্রদাহ
- ☘পেটে অস্বস্তি ও পেট ব্যথা
- ☘বমি বমি ভাব ও বমি
- ☘ডায়রিয়া
- ☘আমাশয়
- ☘ফুড পয়জনিং
- ☘কোষ্ঠকাঠিন্য
- ☘পেটে গ্যাস
- ☘পেট ফাঁপা
- ☘জন্ডিস
- ☘এপেন্ডিসাইটিস
- ☘এ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি
- ☘বদহযম
- ☘অজীর্ন রোগ
- ☘হাইপার এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস
- ☘হাইপো এসিড গ্যাস্ট্রাইটিস
- ☘আলসার
- ☘আইবিএস
- ☘পিত্তথলির প্রদাহ
- ☘অন্ত্রের প্রদাহ
- ☘পাইল্স বা অর্শ
- ☘বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার
- ☘পাকস্থলির ক্যান্সার
- ☘কোলন ক্যান্সার
- ☘অগ্ন্যাশয় প্রদাহ
- ☘হার্নিয়া
- ☘দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা
- ☘ওজন হ্রাস
- ☘অ্যানিমিয়া (রক্তশূন্যতা)
- ☘হাড়ের দুর্বলতা
- ☘ত্বকের সমস্যা
- ☘মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
- ☘শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস
- ☘ক্রোন’স ডিজিজ
- ☘সিলিয়াক ডিজিজ
- ☘এবং আরো অনেক
বুঝতেই পারছেন, এতসব সমস্যা- যার কোন একটাতে আক্রান্ত হলেই জীবন ঝালাপালা হয়ে যায়, কতগুলোতে আছে মৃত্যুঝঁকি- সবই পরিপাক বা হযমের জটিলতার কারনে।
শেষকথা
আশার কথা হল, আপনি এ সব কিছু থেকেই বেঁচে থাকতে পারেন যদি আপনি আপনার গাট (Gut) বা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের যত্ন নেন। হযম প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেন এবং শক্তিশালী রাখেন।
ছোটবেলা আমরা মজা করে প্রশ্ন করতাম, সবচেয়ে আরাম কোন জিনিসে- অনেকে অনেক কিছু বলত। শেষে জবার দিয়ে দিতাম—পায়খানায়।
সত্যিই, যদি আপনার পায়খানা স্বাভাবিক বা ক্লিয়ার থাকে আর আপনার পেটের স্বাস্থ্য ভাল থাকে, হযম ক্রিয়া শক্তিশালী থাকে, তাহলে আপনার মত সুখি আর কে?
সুতরাং প্রতিদিন পেটের বা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন, পেটকে সময় দিন- আপনার সার্বিক সুস্থ্যতার জন্য এটাই হোক প্রথম প্রায়োরিটি।
☘ পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
☘ কমেন্ট করুন প্লিজ, আপনার কমেন্ট এপ্রিশিয়েট করা হবে।