টিকা কি? একবার টিকা দিলে কিভাবে সারাজীবন কাজ করে?

টিকা কি

টিকা বা ভ্যাক্সিন (Vaccine) হল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা Immune System এর একটি অংশ। আমরা ইতোপূর্বে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছি। আপনি নিশ্চয় সেটা পড়েছেন। না পড়ে থাকলে নিচের লিঙ্ক অনুসরন করে পড়ে নিন-

পড়ুন: আপনার ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) চেক করেছেন কখনো?

ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

সংক্ষেপে, আমাদের শরীরের কিছু কিছু রোগ হয় রোগ জীবাণুর সংক্রমনের কারনে। অর্থাৎ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও বিভিন্ন পরজীবির আক্রমনে। এ সমস্ত রোগের মধ্যে রয়েছে টাইফয়েড, পোলিও, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, কলেরা, হাম, বসন্ত, হেপাটাইটিস, করোনা ভাইরাস ইত্যাদি।

এ সমস্ত রোগের জীবাণুকে ধ্বংস করে রোগকে প্রতিরোধ করার বা সারিয়ে তোলার সিস্টেম বা ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেহের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই দিয়ে রেখেছেন। যাদের ইমিউনি সিস্টেম শক্তিশালী তারা এ রোগগুলোতে সহজে আক্রান্ত হয়না বা আক্রান্ত হলেও সহজেই সুস্থ হয়ে উঠে। আমরা করোনার সময়ে দেখেছি, অনেকেরই করোনা পজিটিভ হওয়ার পরেও তারা স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করেছে, কাজকর্ম করেছে। এবং এক সময় করোনা নেগেটিভ হয়ে গেছে। তাদের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকার কারনেই করোনার ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছেন।

আর যাদের ইমিউনি সিস্টেম দুর্বল, তারা উপরোক্ত রোগগুলোতে সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ রোগ ভোগের কষ্ট পায়, অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। এক্ষেত্রে ডাক্তাররা যে চিকিৎসা দেন, সেটা কি? চিকিৎসাটা হল- বাইরে থেকে ওষুধ, এন্টিবায়োটিক বা টিকা প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে ইমিউনি সিস্টেমকে সাহায্য করার বা শক্তিশালী করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

টিকা তাহলে কি?

টিকা এবং এন্টিবায়োটিক আমাদের ইমিউনি সিস্টেমেরই একটি অংশ বা ইমিউনি সিস্টেমের সাহায্যকারী। ইমিউনিটি দুই প্রকার; যথা- ১. জন্মগত ইমিউনিটি- যা আমরা জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকি। ২. অর্জিত ইমিউনিটি- যা আমরা সারাজীবন ধরে খাবার দাবারের মাধ্যমে, লাইফস্টাইল অনুসরনের মাধ্যমে এবং এন্টিবায়োটিক ও টিকার মাধ্যমে পেয়ে থাকি।

অর্থাৎ টিকা হল আমাদের অর্জিত ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি অংশ। নির্দিষ্ট টিকা গ্রহনের মাধ্যমে আমরা নির্দিষ্ট রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ইমিউনি সিস্টেমকে সাহায্য করি।

টিকা কিভাবে ইমিউনি সিস্টেমকে সাহায্য করে? এর জন্য আমাদের বুঝতে হবে ইমিউনি সিস্টেম কিভাবে জীবাণুকে ধ্বংস করে।

ইমিউনি সিস্টেম কিভাবে জীবাণুকে ট্র্যাক করে?

ইমিউনি সিস্টেম বিভিন্ন জৈবিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে জীবাণুকে ট্র্যাক করে; যেমন-জীবাণুকে প্রবেশে বাধা দিয়ে, জীবাণু মেরে ফেলে, ফ্যাগোসাইটোসিস পদ্ধতিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বহুল পরিচিত পদ্ধতিটি হল- এন্টিবডি সৃষ্টি করা। যা টিকাদান পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ টিকা এন্টিবডি সৃষ্টিতে সাহায্য করার মাধ্যমে জীবাণুকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। তাহলে চলুন জেনে নিই এন্টিবডি কিভাবে তৈরি হয়।

এন্টিবডি তৈরির পদ্ধতি

রক্তের তিন ধরনের কনিকা আছে- লোহিত কনিকা (RBC), শ্বেত কনিকা (WBC), অনুচক্রিকা (Platelets)। ইন্টিবডি তৈরির কাজ করে শ্বেত রক্ত কনিকা বা White Blood Corpuscles। শ্বেত রক্ত কনিকা কিভাবে ইন্টিবডি তৈরি করে?

কোন একটি রোগ জীবাণু প্রথমবার দেহে প্রবেশ করলে ইমিউনি সিস্টেম সেটাকে বাইরের জিনিস বা ফরেন বডি (Foreign Body) হিসাবে চিহ্নিত করে এবং প্রধানত শ্বেতকনিকা এর বিপক্ষে এন্টিবডি তৈরি করে। অর্থাৎ জীবাণু (যেমন-ব্যাকটেরিয়া) দেহে সংক্রমন ঘটাতে পারুক বা না পারুক, শ্বেত কনিকা ধীরে ধীরে এর বিপক্ষে একটি প্রতিরোধী তৈরি করে এবং জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে। এটাই এন্টিবডি (Antibody)।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল- রোগ সেরে যাওয়ার পর, পরবর্তীতে একই রোগের জীবাণু যখন পুনরায় দেহকে আক্রমন করে, তখন পূর্ব থেকে তৈরি থাকা ইন্টিবডি তাকে চিনে ফেলে এবং সাথে সাথে মেরে ফেলে, আর রোগের বিস্তার ঘটতে দেয়না। সেজন্য আমরা দেখতে পাই যে, কেউ একবার হাম বা ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেলে আর সারাজীবন এ রোগে আক্রান্ত হয়না।

তাহলে আমরা এখন প্রশ্ন করতে পারি- টিকা কিভাবে এন্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে বা এন্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করতে টিকার ম্যাকানিজ্‌মটা কি?

এন্টিবডি তৈরিতে টিকার ম্যাকানিজ্‌ম কি?

এ পর্যায়ে আমরা আমাদের প্রশ্নের এক চমৎকার মিমাংসায় চলে এসেছি। অর্থাৎ টিকা ইন্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে আমাদেরকে রোগ থেকে বাঁচায়। উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, একবার রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে তার নিজস্ব এন্টিবডি দেহে তৈরি হয় এবং পুনরায় একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। কিন্তু দেখা গেছে যে, কেউ নির্দিষ্ট রোগের টিকা নিলে সে সেই রোগে জীবনে কখনোই আক্রান্ত হয়না। তাহলে এর রহস্যটা কি?

আসলে এটা রহস্য নয়, এটাকে বলা যায় চালাকি। টিকা ইমিউনি সিস্টেম এর সাথে চালাকি করে শ্বেত কনিকাকে দিয়ে এন্টিবডি তৈরি করে নেয়। কি, তাজ্জব মনে হচ্ছে? কিন্তু এটাই ঠিক। শুনে নিন তাহলে।

টিকা কিভাবে চালাকি করে এন্টিবডি তৈরি করে?

আসলে কোন একটি রোগের টিকা তৈরি হয় ঐ রোগেরই দুর্বল, অক্ষতিকর বা মৃত জীবাণু দিয়ে, যাদের মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা থাকেনা। যে কোনভাবেই হোক, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেটা করা হয়। যখন ঐ রোগের টিকা (ধরি- হামের টিকা) কোন মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হয় তখন ইমিউনি সিস্টেম সেটাকে আসল জীবাণু বলেই ধরে নেয় এবং এর বিপক্ষে এন্টিবডি তৈরি করে ফেলে। আর একবার এন্টিবডি তৈরি করে ফেললে আর যায় কোথায়, সেটা সারা জীবন ঐ নির্দিষ্ট রোগটি থেকে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই হল টিকার ম্যাকানিজ্‌ম।

প্রশ্নঃ একবার টিকা দিলে কিভাবে সারাজীবন কাজ করে?

উত্তরঃ তাহলে কি আমাদের টাইটেলের সেই প্রশ্নটির মিমাংসা হয়ে গেলনা যে- একবার টিকা দিলে কিভাবে সারাজীবন কাজ করে?

পৃথিবীতে প্রথম ভ্যাক্সিন বা টিকা আবিস্কার করেন এডোয়ার্ড জেনার যার জন্ম ১৭৪৯ সালে ও মৃত্যু ১৮২৩ সালে। প্রায় দুইশত বৎসর আগে জেনারের মাথায় কিভাবে এ বুদ্ধি এল সেটা সত্যিই এক রহস্যময় বিষয়।

মন্তব্য করুন